নির্মল ধর: প্রথম ছবি ‘অব্যক্ত’ দিয়ে বেশ খানিকটা চমক যেমন দিয়েছিলেন তরুণ অর্জুন দত্ত, তেমনই সম্ভাবনারও আশা জাগিয়েছিলেন। সম্ভাবনা অর্থাৎ টালিগঞ্জিয়া বাণিজ্যিক ফর্মুলা তো বটেই, পাশাপাশি অন্যধারার একটা ছকে ফাঁদা ফর্মুলার বাইরে দাঁড়িয়ে ছবি বানাবেন অর্জুন। গল্পের ভাবনায় তো বটেই, গল্পের বিন্যাসেও সিনেমাটিক চমক পাওয়া যাবে। অর্জুনের (Arjunn Dutta) এই দ্বিতীয় ছবি ‘গুলদস্তা’ সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি জলঞ্জালিও যেমন দেয়নি, তেমনি বাড়তি কোনো প্রাপ্তিও নেই। তিনি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
প্রথম ছবিতে দুই পুরুষের মাঝে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আভাস দিয়েছিলেন, স্বামী-স্ত্রী ও তৃতীয় পুরুষের সম্পর্কটাকে কখনোই উচ্চকিত করে দেখাননি। সেটাই ছিল তাঁর সিনেমা ভাষার প্রতি দখলের কেরামতি। কিন্তু এই ছবিতে তিনি এনেছেন তিন নারী চরিত্র। শ্রীরূপা (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়), রেণু(দেবযানী চট্টোপাধ্যায়) ও অবাঙালি সেলস লেডি ডলি (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়)। প্রথম দু’জন উচ্চবিত্ত পরিবারের বধূ, কিন্তু মনে সুখ নেই। শ্রীরূপা বিছানায় শীতল, স্বামী অর্ণব তাই অফিস কর্মীর প্রতি আকৃষ্ট শারীরিক ভাবে। শ্রীরূপা মোটেই শীতল নয়, সে শান্ত। রেণুর স্বামী বাইরে থাকেন, অসুস্থ শাশুড়ি আর উঠতি বয়সের ছেলের বেপথু হবার কারণে তার অশান্তি। এদের মধ্যে এসে পড়েন প্রসাধনী ‘রূপকেয়ার’ এর সেলস লেডি ডলি। শুধু নিজের কোম্পানির প্রসাধনী বিক্রি নয়, ডলি বাড়তি উপহার দেন সমবেদনা, ভালবাসা, সহানুভূতি, বিশ্বাস ও ভরসা। এটা দিয়েই ডলি মন জয় করে নেন দুই মহিলার। সাময়িক ভাবে দুজনেরই অসুখ দূরে যায়। স্বাভাবিক হয়ে ওঠে দুই নারী। ঠিক এই সময়েই হঠাৎ বেপাত্তা হন ডলি, ঘটনাক্রমে শ্রীরূপার ঘর থেকে একটি দামী গয়নার হদিশ মেলে না।
খোঁজ খবর করতে গিয়ে দুই মহিলা আবিষ্কার করেন ডলির অন্য এক জীবন। ভেঙ্গে পড়েন দু’জনেই। বাইরের লোককে খুশিতে রাখার জন্য কী মিথ্যার আশ্রয় না নিয়েছিলেন ডলি! বেপাত্তা হওয়ার মতো আবার হঠাৎ একদিন এক গোছা ফুল (গুলদস্তা) নিয়ে শ্রীরূপার বাড়িতে। সেই একই ফুরফুরে মেজাজে, সবাইকে মজিয়ে রাখতে। ছবির সমাপ্তি দৃশ্যটি সত্যিই মনে রাখার মতো। একইরকম হাসি আর উচ্ছ্বলতা নিয়ে ডলি বলেন “ওকে ডিয়ার”! ভেতরে তখন চলছে উথলে ওঠা কান্না, নিজের সব দুঃখ, কষ্ট, লজ্জা, অসহায়তা ঢাকার জন্য। সুন্দর অভিব্যক্তি তখন স্বস্তিকার (Swastika Mukherjee)। টেবিলের ওপাশে বসে অন্য দুই মহিলারও অস্বস্তিকর অবস্থা, কারণ ডলির আসল পরিচয়টা তাঁদের অজানা নেই! তিনটি নারী চরিত্রের পারস্পরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর্বটি নিপাট গড়েছেন অর্জুন।
ডলির আগমন নিয়ে কিঞ্চিৎ ‘নাটক’ থাকলেও, তাঁকে অতি বিশ্বাস করে ফেলাটা খুবই তাড়াতাড়ি ঘটে যায়। ডলির ওষুধে ওরা প্রত্যেকেই সেরে ওঠেন- এটাও কিঞ্চিৎ কাকতালীয় মনে হয়। অফিস প্রেমিকার সঙ্গে বিরোধ, তার নতুন পুরুষ বন্ধু জোগাড় হওয়া, বেপথু তরুণের হঠাৎই মায়ের অসুস্থ হয়ে পড়ায় হৃদয়ের পরিবর্তন সব ঘটনাগুলো খুবই সাজানো লাগে। বাস্তবের অভাব চোখে পড়ে। ‘অব্যক্ত’র মত বাস্তব ও জীবন সমৃদ্ধ ছবির পর ‘গুলদস্তা’ (Guldasta) নিশ্চিতভাবেই রঙিন ফুলের সমাহার, কিন্তু গন্ধ কোথায়! রঙিন ফুলের কাজটি করেছেন তিন নারী চরিত্রের তিন শিল্পী। স্বস্তিকাকে এক নম্বরে রাখতেই হচ্ছে। তাঁর অভিনয়ের মধ্যে ‘অভিনয়’ কাজটি সত্যিই বেশ স্বচ্ছন্দ, স্বতস্ফূর্ত। শরীর শীতল শ্রীরূপাকে শুরু থেকেই এমন রুগ্ন দুর্বল অসুস্থ দেখানো কেনো? সে মানসিক রোগী, শারীরিক নয়। তবে অভিনয়ে অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় (Arpita Chatterjee) কোনো খামতি রাখেননি। স্বামীর সঙ্গে বিছানায় শীতলতার প্রকাশ আবার সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি প্রকাশেও তিনি সমান দক্ষ। রেণুর ভূমিকায় খুবই সংযত ও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন দেবযানী (Debjani Chatterjee) এবং অনেকটাই পেরেছেন তিনি। সন্তানের চরিত্রটি ঠিক মত গড়ে না ওঠায় অভিনব কাঞ্জিলাল আর কি করবেন! পরিচালনার কাজে মনে রাখার মতো মুহূর্ত শুধু শেষ শটটি ছাড়া অন্যকিছু তো চোখে বা মনে পরছে না। যা পড়েছিল ‘অব্যক্ত’র সময়। যাই হোক, অর্জুন বাণিজ্যে ভেসে পড়েননি, এটাই আসল কথা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.