বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) ‘ফেলুদা’ উপন্যাস ‘দার্জিলিং জমজমাট’ একটি পুজো সংখ্যায় ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায় (Srijit Mukherji) তাঁর সিরিজে এই সময়কালটাই ধরেছেন। লালমোহনবাবুর রোপওয়ে চড়ার অভিজ্ঞতার পরে ‘ফাঁড়া’ কেটে যাওয়ার মন্তব্যে সেটা টের পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘ফেলুদা’ সিরিজে কিছু গল্প সিনেমা করার জন্য বেশি উপযোগী সেটা সবসময়ই মনে হয়। তাঁর বেশ কিছু গল্প নিয়ে সিনেমা আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওয়েব সিরিজে এখনকার যা প্যাটার্ন বা চাহিদা সেখানে ‘ফেলুদা’র গল্প বলা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
সাত কিংবা আটের দশকের বাঙালির যে রসবোধ, আড্ডার মেজাজ, সেই সময়কার বাঙালিয়ানার সঙ্গে একজন শানিত বুদ্ধির বাঙালির সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি মিশিয়ে ‘ফেলু মিত্তির’-এর উৎপত্তি। সেটা এই ২০২২ সালে আমরা পর্দায় দেখার সময় কোন আঙ্গিক থেকে দেখব এটা একটা প্রশ্ন। তাছাড়া ওয়েব সিরিজে সবচেয়ে জোরাল দিক হল, শক্তিশালী সাবপ্লটের বিভিন্ন স্তরের উপস্থিতি। কিন্তু ফেলুদার মূল গল্পে সাবপ্লটের উপস্থিতি থাকলেও সেগুলো এক্সপ্লোর হয় না। ফলে যা বইয়ে আছে, সেটাই যদি প্রায় হুবহু ওয়েব সিরিজে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা বেশ সরল এবং তরল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
‘হইচই’ ওয়েব প্ল্যাটফর্মের সিরিজ ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি : দার্জিলিং জমজমাট’-এও (Feludar Goyendagiri : Darjeeling Jawmjawmat) খানিকটা তাই হয়েছে। পরিচালকের অভিপ্রায় না থাকলেও। মূল গল্প এক রেখে এমনকী সংলাপও (প্রায় আশি শতাংশই বই থেকে নেওয়া) এক রেখে এই সিরিজ তৈরি হয়েছে। গল্প আমাদের জানা, দার্জিলিংও বাঙালির চেনা। সেই ক্লক টাওয়ার, চেনা ম্যালের ছবি, কেভেনটার্স, গ্লেনারিজ, পাইনবন– এই গোয়েন্দা গল্পে একটা আলাদা আমেজ তৈরি করে। কিন্তু চেনা দার্জিলিংকেও অচেনা লাগল সেপিয়া টোনের জন্য। গোটা সিরিজেই এই হলদে-সেপিয়া রঙের ব্যবহার। সেটা কি পুরনো সময়টা ধরার জন্য? যদিও তাতে পাহাড়ের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ঢাকা পড়েছে।
আর ওয়েব সিরিজে যে বাড়তি পাওনা বা বোনাসের আশা থাকে সেটা মিসিং। কারণ মূল গল্পে তো সেটা নেই। সিনেমা হলে তাও একটা কমপ্যাক্ট ব্যাপার থাকে, কিন্তু স্তর এবং সাবপ্লটের জোরাল উপস্থিতি না থাকলে ওয়েব সিরিজে সেই ঘন ব্যাপারটা তৈরি হয় না। তবে ‘ফেলুদা’র গল্পে বাড়তি সংযোজন বাঙালি কীভাবে নেবে সেটা অন্য ব্যাপার।
ফেলুদার চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরী (Tota Roy Chowdhury), তোপসের চরিত্রে কল্পন মিত্র এবং লালমোহন গাঙ্গুলির চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তীকে (Anirban Chakraborty) ভালই লাগে। ফেলুদা আর লালমোহনবাবুর বাক্যালাপ অবশ্য বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কোথাও কোথাও লালমোহন হিসাবে অনির্বাণ চক্রবর্তী ফেলুদাকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। তোপসে হিসাবে কল্পনের এখানে মাথা নাড়া ছাড়া খুব বেশি কিছু করার ছিল না। কল্পনের এক্সপ্রেশন ভাল, তাই উতরে দিয়েছেন। কিন্তু ভারটা লালমোহন বাবুর দিকে বেশি এটা স্বীকার করতেই হয়। পুলক ঘোষালের চরিত্রে অভিনেতা রাহুল স্বল্প স্ক্রিনটাইমে তার কমিক টাইমিং কাজে লাগিয়েছেন।
ওয়েব সিরিজের সময়কাল ১৯৮৬ ধরা হয়েছে গল্পের প্রকাশ কাল অনুযায়ী আগেই বলেছি। ইন্টারেস্টিংলি ম্যালের দিকে হেঁটে যাওয়ার পথে ‘নাগিনা’ সিনেমার পোস্টার স্পষ্ট দেখা যায়, এই ছবির মুক্তিও ১৯৮৬। গোর্খাল্যান্ড নিয়ে মুভমেন্টও শুরু হয়ে গিয়েছে ১৯৮০ সাল থেকে। ‘উই ওয়ান্ট গোর্খাল্যান্ড’ স্লোগানও চোখে পড়ে সৃজিতের ওয়েব সিরিজে। ফেলুদার মুখে ‘ব্যোমকেশ’-এর উত্থাপন এবং ‘চিত্রচোর’ উপন্যাসের উল্লেখ একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে। সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ‘চিত্রচোর’ গল্পে একটি স্কেচ চুরি এবং সম্ভাব্য ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ছিল। যাঁরা ‘ফেলুদা’র গল্পের ভক্ত তাঁরা খুশি হবেন, ‘দার্জিলিং জমজমাট’কে সেই একইভাবে পেয়ে। কিন্তু যাঁরা আরও ‘জমজমাট’ কিছু চান, তাঁরা নিরাশ হবেন।
ওয়েব সিরিজ – ফেলুদার গেয়েন্দাগিরি : দার্জিলিং জমজমাট
অভিনয়ে – টোটা রায়চৌধুরী, অনির্বাণ চক্রবর্তী, কল্পন মিত্র, বরুণ চন্দ, সুপ্রভাত দাস, সাহেব ভট্টাচার্য, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচালনা – সৃজিত মুখোপাধ্যায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.