চারুবাক: এখনকার বেশির ভাগ বাংলা ছবি হয় গোয়েন্দা, নয় থ্রিলার, প্রেম কিংবা প্রেমের সংকট নিয়ে। আর তাও না হলে সবকিছুর একটি ফর্মূলাভিত্তিক ছবি তৈরির প্রবনতা। সেদিক থেকে ছোট ও বড়পর্দার অভিনেতা দেবদূত ঘোষ প্রথমবার পরিচালনায় এসেই সাহিত্যিক প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘আদরিনী’কে বেছে নিয়েই বুঝিয়ে দেন তিনি ব্যবসার চাইতেও দর্শককে সুন্দর একটি কাহিনি উপহার দিতে বেশি আগ্রহী।
গল্পের কিছু নাটকীয়তা নিয়ে, একটি সর্বজনগ্রাহ্য, গ্রাম বাংলার পটভূমিতে পশু ও মানুষের ভালবাসার এক নিবিড় বন্ডিং দেখাতে চেয়েছেন দেবদূত। আর সেটা করতে গিয়ে তিনি ‘আদর’ (Aador) ছবির আদি ও অন্তে অন্য আরও একটি ছোট্ট গল্পের অবতারণা করেছেন। পরিকল্পনাটি ভাল, তবে সরাসরি গল্পেও তিনি যেতে পারতেন। আদরিনী নামে একটি হাতির সঙ্গে মালিক জয়রাম ও তাঁর ছোট্ট নাতনি মাধুর যে অনুচ্চারিত মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেটাই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু।
জমিদারবাড়ির বাঁধা উকিল জয়রামের বিশ্বাস ছিল তাঁর একটা অনুরোধ নিশ্চয়ই রাখা হবে। জমিদার কন্যার বিয়েতে যাবার জন্য একটা হাতি চেয়েছিলেন তিনি। জমিদারগিন্নি হাতি পাঠাননি। সম্মানে আঘাত লাগে উকিলবাবুর। অগত্যা জমানো সব টাকা খরচ করে তিনি একটি হাতি কিনে বিয়ের দিন সন্ধ্যাবেলা হাজির হন জমিদার বাড়ি। এদিকে উঠতি বয়সী নাতনি মাধুকে পাত্রস্থ করতে বড় ছেলে জেরবার। পাত্র দশ হাজার টাকা পণ চেয়েছে জানিয়ে বাবা জয়রামকে বাধ্য করেন স্নেহের হাতিটি বিক্রি করতে।
গল্পের পরিণতি বলছি না। শুধু এটা জানাই মালিক জয়রাম ও নাতনির সঙ্গে হাতির সখ্যতা, বন্ধুত্ব, ভালবাসার সম্পর্কটি গড়ে ওঠার কাজটি প্রায় করতেই পারেননি পরিচালক দেবদূত। অথচ, হাতিটি বিক্রি করতে হবে জেনে ওই দু’জনের যে আশাভঙ্গের প্রতিক্রিয়া, জয়রামের কান্নাকাটি, হতাশা সবটাই কেমন আরোপিত লাগে। দর্শক হিসেবে দুঃখ অনুভব করা গেল না। সবচেয়ে ভাল হতো ছবিরই একটি গানকে দাদু-নাতনির সঙ্গে পিকচারাইজ করা। পশুর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটাই যদি যথাযথ স্থাপিত না হয়, তাহলে পরবর্তী আবেগঘন দৃশ্যগুলো তেমন আবেদন রাখে না দর্শকের কাছে।
অথচ রজতাভ দত্তর (Rajatava Dutta) আবেগ স্নেহ মেশানো স্বরে ‘আদরিণী’কে বিদায় জানানোর সময়ে “বাপের উপর অভিমান করিস না, রাগ করিস না আমার উপর” ইত্যাদি সংলাপ বলার সঙ্গে ফুঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠার জায়গাটি সত্যিই অসাধারণ। ছবির প্রথমার্ধে যদি মানুষ ও পশুর মধ্যে স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্কটির ভিত তৈরি করে রাখা যেত, তাহলে ওই দৃশ্যটি আরও বেশি মনোগ্রাহী হতে পারত।
না, সেজন্য পরিচালক দেবদূতের প্রথম কাজকে খাটো করা যাবে না মোটেই, এই দায়টা ছিল চিত্রনাট্যকারের। দেবদূত সহজ সরল ন্যারাটিভে গল্পটি বলেছেন মসৃণ ভাবেই, কোথাও হোঁচট নেই। তন্ময় বসুর আবহ তাঁকে যথেষ্ট সাহায্যও করেছে। অসীম বসুর কামেরাও ত্রিপুরার কৈলাশহরের প্রকৃতিকে সুন্দর তুলে ধরেছে। দর্শকের চোখ আরাম পেতে পারে।
অভিনয়ে রজতভর কথা আগেই বলেছি, সহ-শিল্পী হিসেবে বড় বউমার চরিত্রে বাসবদত্তাকে যেমন মানিয়েছে, তেমনি তাঁর অভিনয়ও শান্ত মেজাজে। মাধুর চরিত্রের শিল্পীও বেশ ভাল। জয়রামের বন্ধু ও প্রতিবেশীর চরিত্রের মানুষটি বড্ড আন্তরিক ও সম্ভ্রম আদায় করে নেন। একটি ক্যামিও চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী নিজের মনের মতো ফরেস্ট অফিসারের চরিত্র পেয়ে বেশ জমিয়ে অভিনয় করেছেন। মানসী সিনহা, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পের অতিরিক্ত সংযোজনে খুবই স্বল্প জায়গা পেয়েছেন। ‘আদর’ না রেখে ছবির নাম ‘আদরিণী’ রাখলে আরও যুক্তিযুক্ত হতো। তবে এমন একটি পরিচ্ছন্ন গল্পের সাধাসিধে চিত্রায়ন যে দর্শকের একটু বেশিই পৃষ্ঠপোষকতা চায়। সেটা পাবে কী?
ছবি – আদর
অভিনয়ে – রজতাভ দত্ত, তুলিকা বসু, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়, পারিজাত চৌধুরী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, মানসী সিনহা প্রমুখ
পরিচালনা – দেবদূত ঘোষ
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.