বিশাখা পাল: এই প্রথম সেলুলয়েডের সঙ্গে পরিচিত হলেন মিতিন মাসি। প্রথম দর্শন হিসেবে মোটের উপর উতরে গেলেও অসাধারণ কি বলা যাবে অরিন্দম শীলের এই নতুন গোয়েন্দাকে? সুচিত্রা ভট্টাচার্য লেখনিতে কৃপণতা করেননি। ঢেলে সাজিয়েছিলেন তিনি মিতিন ওরফে প্রজ্ঞাপারমিতাকে। মিতিনকে লেখিকা বানিয়েছিলেন বিদুষী, বুদ্ধিমতী, রহস্যোদ্ঘাটনে পারদর্শী, অদ্ভুত অ্যানালিসিস করার ক্ষমতার সঙ্গে বঙ্গললনার স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতা ও লালিত্য দিয়ে। ছবিতে যেন চেষ্টা করেও সেই অনুভূতি দিতে পারল না কোয়েল-অরিন্দম জুটি। শুরু থেকে শেষ, ঠিক যেন ফেলুদা আর রোহিত শেট্টির খিচুড়ি গল্প।
গল্পের কেন্দ্র পর্সি রুস্তমজি। তাঁর ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে। পুলিশকে না জানিয়ে ছেলের খোঁজ পেতে মিতিনের স্মরণাপন্ন হন তিনি। প্রথম সাক্ষাতেই মিতিন চমকে দেন রুস্তমজিকে। ছোট্ট ছোট্ট কিছু কথা বলে বুঝিয়ে দেন, খুব একটা ভুল লোককে তিনি হায়ার করেননি। এখানেই লাগে প্রথম খটকা। ‘গ্যাংটকে গন্ডোগোল’ গল্পে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, প্লেনের সিটে বসা শশাঙ্কবাবুকে দেখে ফেলুদা পটাপট বলে দিয়েছিল তিনি কয়েক ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছেন, জাতিতে বাঙালি, ইত্যাদি… ইত্যাদি। অনেক সময় মক্কেলদের এভাবে চমকে দেওয়া ফেলুদার স্বভাবে ছিল। কিন্তু মিতিন মাসির নয়। মগজাস্ত্র তাঁরও শানিত ছিল। কিন্তু মক্কেলকে বারবার চমকে দেওয়া টুপুরের মাসির ধাতে ছিল না। তবে সেলুলয়েডের মিতিনকে এসব করতে দেখে গল্পের সঙ্গে মেলাতে একটু সমস্যা হবে বই কি।
এই মিতিন আবার মার্শাল আর্টেও দক্ষ। ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছেন। মেয়েদের স্বনির্ভর করতে ক্যারাটে-কুংফু শেখার জন্য উৎসাহিত করে। এর মধ্যে বাড়াবাড়ি কিছু নেই। বরং বর্তমানে মেয়েদের নিজেদের বাঁচাতে হলে এসব শিখে রাখা অবশ্যই উচিত। এপর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু মার্শাল আর্টের মারপ্যাঁচ আর গাড়ি নিয়ে চেজ করার দৃশ্য যেন বড় বেশি করে রোহিত শেট্টির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মিতিনকে স্মার্ট বানাতে গিয়ে যেন দাঁড়িটাই টানতে ভুলে গিয়েছেন পরিচালক। তাই মিতিন পাশের বাড়ির মেয়ে হওয়ার বদলে এখানে পেশাদার গোয়েন্দা। সুচিত্রা ভট্টাচার্য যেভাবে মিতিনকে চিনিয়েছিলেন, অরিন্দমের মিতিনকে তার থেকে অনেক বেশি কঠিন মনে হয়। তবে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে বাঙলি মেয়েটাই কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। প্রজ্ঞাপারমিতা কিন্তু তেমন ছিলেন না।
তবে মিতিনের স্যাটেলাইট টুপুর বেশ প্রাণবন্ত। রিয়া বেশ ভাল মতোই হোমওয়ার্ক করে চরিত্রে ঢুকেছেন। মিতিনের স্বামী পার্থর চরিত্রে শুভ্রজিৎও যথাযথ। কিন্তু আলদা করে বলতে হবে বিনয় পাঠকের কথা। এই একটি হীরে ভালই ব্যবহার করেছেন অরিন্দম শীল। বিনয় পাঠক উঁচু দরের অভিনেতা। এখানে তিনি তা প্রতি ইঞ্চিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাংলায় তিনি সাবলীল নন। কিন্তু পার্সি চরিত্রে যেভাবে যেটুকু বাংলা বলেছেন, তার কোনও তুলনাই নেই। একবারের জন্যও মনে হয়নি তিনি জোর করে বাংলা বলছেন বা বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে তাঁর একটুও সমস্যা হচ্ছে। বরং কোয়েলকে তাঁক সামনে অনেক ম্লান লেগেছে। সত্যিই অভিনেত্রীকে বোধহয় আরও পোক্ত হওয়া দরকার ছিল।
মিতিনমাসি চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা খবব সহজ কাজ নয়। মিতিনের বুদ্ধিমত্তার দিকে জোর দিতে গিয়ে কোয়েল হারিয়ে ফেলেছেন তাঁর সহজাত অভিনয়। নমনীয়তার অভাব যেন বড় বেশি করে চোখে পড়ে। পরিচালক যেন বাঁধুনি শক্ত করতে গিয়ে অতিরিক্তই শক্ত করে ফেলেছেন। সেই বজ্র আঁটুনিতেই হাঁসফাঁস করছে ‘মিতিন মাসি’। তবে গল্পের মিতিনের সঙ্গে না মেলালে মন্দ লাগবে না সেলুলয়েডের মিতিনকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.