চারুবাক: তুলনা আসবেই। না এসে উপায় নেই। পীযূষ বসুর ‘সন্ন্যাসী রাজা’ সেই সময়ে (মধ্য সত্তরে) হইচই করে চলেচিল উত্তমকুমারের জন্য। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রীর চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবী। নাটক অঘটন আর ঘটনার সমষ্টি সমাবেশে পীযূষ সুর চিত্রনাট্য ছিল প্রায় তুবড়ির মতো। এবং সময় ওপরে ছিলেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চুম্বক উত্তমকুমার। তিনি প্রায় একই ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে স্ত্রিন প্রেসেন্স দিয়ে দর্শককে তো বটেই। চিত্রনাট্যের চিত্তও ফালাফালা করে দিয়েছিলেন।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের এই নবতম সংস্করণ ‘এক যে ছিল রাজা’ কিন্তু ‘সন্ন্যাসী রাজা’ থেকে যোজন দূরে। বিক্রমপুরের রাজা মহেন্দ্র চৌধুরীর মৃতদেহ উধাও হয়ে ১২ বছর পর সুন্দর দাস নাম নিয়ে শ্মশান থেকে নাগা সন্ন্যাসীর বেশে ফিরে আসা এবং তাঁর মেজোবোনের তোলা মামলটাই সৃজিতের চিত্রনাট্যের মেরুদণ্ড। কোর্টরুম নাটকটাকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। স্ত্রী চন্দ্রাবতীর চরিত্র প্রায় ক্যামিও পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফিরে আসা সন্ন্যাসী সত্যিই রাজা কিনা এটা নিয়ে প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত লড়াই হয়। সেখানেও জয় হয় বোনের। কিন্তু তবুও ভারতীয় বিচার ও আদালতের ইতিহাসে এই মামলা এক প্রহেলিকা হয়ে আছে এখনও। সৃজিত সেই প্রহেলিকার আবরণ অনেকটাই উন্মোচন করেছেন। বলতে পারি, তথ্য ইতিহাস ঘেঁটে ছবিতে সত্য প্রকাশের চেষ্টাটি আন্তরিক। এবং সেলুলেডে সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে তিনি শুধুই আন্তরিক নন।
[ গড়পড়তা ছবি থেকে অনেকটাই আলাদা ‘ভিলেন’, রয়েছে টুইস্ট! ]
আলো-আঁধারিতে ঘেরা রাজার জীবন। তার মহিলাসঙ্গ নিয়েও অনেক কেচ্ছা। সৃজিত সেই কেচ্ছার কোনও চিত্ররূপ দেননি ব্যবসার খাতিরে। অত্যন্ত আনন্দের কথা। আসলে ব্যবসার মোটিভটাই নেই এই ছবিতে। সুতরাং বাণিজ্যের গ্যারেন্টি নেই এই ছবির ললাটে। কিন্তু আছে বিশ্লেষণ ও অন্তর্তদন্তমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। অতীত আর বর্তমানকে সাদা-কালো ও রঙিনভাবে সাজিয়ে এর রিভার্স এফেক্ট আনার চেষ্টা করেছেন। সুন্দর ভাবনা। নাটককে কখনও মাথা তুলতে দেননি সৃজিত। চিত্রনাট্যের বিন্যাসে সরলরৈখিক মেজাজটি বজায় রেখেও অতীত বর্তমানকে সুন্দ মিলিয়েছেন তিনি। রাজার শবযাত্রার শটটি চারবার চাররকম আলোয় দেখানোর পরিকল্পনাটিও একই সঙ্গে যেমন সাসপেন্স ক্রিয়েট করে, তেমনই অনুপুঙ্খ দর্শনের দাবিও করে। আরও একটা মজার ঘটনা রবীন্দ্রনাথের একটি গানের অপূর্ব ব্যবহার। সঙ্গে ভিস্যুয়াল রযেছে নাগা সন্ন্যাসীর বেশে সুন্দর দাস ওরফে রাজা মহেন্দ্রর রাজবাড়িতে প্রবেশ। একটাই আক্ষেপ- বাদি-বিবাদী পক্ষের দুই উকিল ভাস্কর ও অনুপমার (প্রেমিক প্রেমিকা) সম্পর্কের আভাসটি। যদিও বলা হয়েছে এই পর্বটি বাস্তব নয়। সম্ভবত অপর্ণা-অঞ্জনকে কাস্টিংয়ে রাখতেই হবে, এমন ভাবনা থেকেই চিত্রনাট্যে এমন সমঝোতা। পুরো ছবিটাই যখন অন্তর্তদন্তমূল, সেখানে এটা না করলেও পারতেন সৃজিত।
অভিনয়ে অবশ্যই এক নম্বর নাম যিশুর। উত্তম কুমারের দাপুটে এবং নাটুকে অভিনয় মনে রেখেও বলছি- যিশুকে অনেকাংশেই রক্তমাংসের মানুষ লেগেছে। রাজকীয় গরিমা তাঁর অভিনয়ে নেই। সেটাই তাঁকে আলাদা করে রেখেছে। শুটিংয়ে সময় সম্ভবত প্রতিনিয়তই যিশু উত্তমকুমারের ছায়া থেকে সরে থাকার ধারাবাহিক চেষ্টা করেছেন এবং তিনি সফলও। অভিনয়ে দ্বিতীয় নাম জয়া আহসান। বোনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। আলগা লালিত্যে তিনি নজর কাড়বেনই। অঞ্জন-অপর্ণা জুটির ম্যাজিক কোর্টরুমে ফুটেছে ভালই। দুই ষ়ড়যন্ত্রী ডাক্তার ও শ্য়ালকের ভূমিকায় রুদ্রনীল ঘোষ ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য ভালই। শ্রীনন্দাশংকর এবং রাজনন্দিনী দত্ত তেমন সুযোগই পাননি ক্যামেরার সামনে। এই ছবি আসলে দুজনের। সৃজিত এবং যিশুর। ভাল ছবি। কিন্তু দর্শক নিতে পারবে তো?
[ পুজোয় ফিরল কিশোর আবেগের গপ্পো ‘কিশোর কুমার জুনিয়র’ ]
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.