চারুবাক: ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত প্রথম ছবি “কেদারা” দিয়ে দর্শকের যেভাবে মন জয় করেছিলেন, সেখান থেকে তাঁর কাজের ওপর প্রত্যাশা একটু বাড়তিই ছিল। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে তাঁর এই দ্বিতীয় ছবি ‘বিসমিল্লা’ (Bismillah) সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না। কারণ একটাই, ছবির দৈর্ঘ্য। রাধা,কৃষ্ণ ও রুক্মিণীর ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনীকে আজকের প্রেক্ষাপটে ‘বিসমিল্লা’, ফাতিমা, উমা/লীলার মাধ্যমে যতটাই আধুনিক করার চেষ্টা করুন না কেন, গান স্বপ্নের দৃশ্য বা প্রকৃতির অসাধারণ সৌন্দর্য্য এবং ফাতিমার সঙ্গে বিসমিল্লার শরীরী প্রেমের অনুসঙ্গ এনে ছবির দৈর্ঘ্য দর্শককে ক্লান্ত করবেই! সানাই বনাম বাঁশির সংঘাতটাও রশিদ আলীর মৃত্যুর পর একা বিসমিল্লা ও তাঁর প্রেমের দোটানায় অনেকটাই তরল হয়ে যায়। বাবা রশিদ নামী সানাই বাজিয়ে, কিন্তু মেজো ছেলে বিসমিল্লা আনন্দ পায় বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে, গ্রামে দেখা রাধা কৃষ্ণ লীলার আসরে বাঁশি বাজিয়ে প্রেমিক কৃষ্ণর ভূমিকায়! কিন্তু বৃদ্ধ বাবার অনুরোধে সানাইকেই হাতে তুলে নিতে হয় সংসার প্রতিপালন ও বংশের ধারা বজায় রাখতে। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে থেকেই যায় বাঁশির প্রতি আকর্ষণ। অবচেতনে সে রাধার প্রতিমূর্তি আবিষ্কার করে চকিত দেখা ফাতিমার মধ্যে। ফাতিমাও বিসমিল্লার বাঁশির প্রতি অনুরক্ত। দুজনের পারস্পরিক আকর্ষণ শেষ পর্যন্ত শরীর পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু ছোটমার অনুরোধে তাঁকে বিয়ে করতে হয় হিন্দু মেয়ে উমাকে। কাহিনী চুম্বক এটুকুই।
কিন্তু চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত এবং অবশ্যই পরিচালক ইন্দ্রদীপ গ্রামীণ ব্যবস্থার অন্যান্য দিক ও পরিমণ্ডল তুলে আনতে গিয়ে বিভিন্ন উপকাহিনী তৈরি করেছেন, যা বহুলাংশে ক্লান্তির কারণ হয়। গ্রামীণ মুসলিম পরিবারের একটা সার্বিক চেহারা অবশ্যই দর্শক পেয়ে যান। রশিদ আলির দুই স্ত্রী তিন সন্তানকে নিয়ে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই, দেশের ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের সঙ্গে আধুনিক ডিজে বক্স নিয়ে লড়াই, পোস্ট অফিসের সঙ্গে মোবাইল ফোনের সংঘাতও এসেছে চিত্রনাট্যে। অনেকটাই ম্যাজিক রিয়েলিটির চেহারায়। শুভঙ্কর ভরের ক্যামেরা পুরুলিয়া অঞ্চলের পাহাড় নদী ঘেরা যে প্রাকৃতিক পরিবেশ পেয়েছে সেটিকেই আলো আঁধারিতে আর বিচিত্র রঙে সাজিয়ে জাদু বাস্তবতার এক চেহারা দিয়েছেন পরিচালক। এমনকী, বিসমিল্লার সঙ্গে ফাতিমার অভিসার পর্বও সেই পরাবাস্তবের চেহারা নিয়েছে। পরিচালকের এই কাজগুলো অবশ্যই প্রশংসার। কিন্তু ডিজে শিবু, দাদা হামিদের স্বার্থপরতার কাজগুলো চোখে আঙ্গুলে দিয়ে দেখানোর দরকার ছিল না। ছবির অন্তিম পর্বে বিসমিল্লার বিয়ের জন্য যাত্রা এবং একই সময়ে ফাতিমার মৃত্যুতে তার শেষযাত্রায় বিসমিল্লার সানাই ও বাঁশি বাজাতে উপস্থিত হওয়া নাটকীয় ঘটনা হলেও এবং দৃষ্টগুলির উপস্থাপনা দৃষ্টিনন্দন হলেও ছবির গতির সঙ্গে সাযুজ্য নয়।
তবে এই ছবির গান সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। প্রাচীন সুরে আজকের কথা বিষয়ে ঋতম সেন ও শ্রীজাতর কলমের জোর যেমন দেখিয়েছেন, তেমনি গেয়েছেন অরিজিৎ সিং ও কৌশিকী চক্রবর্তী। অভিনয়ে রশিদ আলির চরিত্রে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কাউকে ভাবাই যায় না। তিনি এক কথায় অনবদ্য। সানাইয়ে ফুঁ দেওয়ার কৌশল থেকে চরিত্রটির ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য এবং সারল্য সবদিক গুলোই তিনি কি সাবলীল ভাবেই না করেছেন। ঋদ্ধি সেন হয়েছেন বিসমিল্লা, তাঁর অভিনয়ে চেষ্টার ছাপ রয়েছে, সর্বত্র স্বতস্ফূর্ত নয়। আত্মগত হয়ে সানাই বাজানোর সময় শিল্পী অত মাথা নাড়ায় না। শুভশ্রী হয়েছেন ফাতিমা, তাঁর চরিত্রায়নে মিস্টিক ভাবটি সুন্দর এসেছে। বাস্তব ও অবাস্তবের এক মিশ্রণ তাঁর চরিত্র। শুভশ্রী অভিনয় সেই দোলাচলটি রেখেছেন। বড়োমার চরিত্রে বিদিপ্তা চক্রবর্তী, শিবুর ভূমিকায় গৌরব চক্রবর্তী, ছোটমার চরিত্রে স্নেহা চট্টোপাধ্যায় এবং মমিনার ছোট ভূমিকার অপরাজিতা আঢ্য সকলেই যথাযথ। পরিচালক ইন্দ্রদীপ পৌনে তিন ঘণ্টার ছবিকে দু সোয়া দুঘন্টায় আনতে পারলে তাঁর জাদু বাস্তবতা এত ক্লান্তিকর হত না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.