সরোজ দরবার: স্মৃতি এক আশ্চর্য বসতবাটি। আমাদের সত্তার অনেকখানি যে কেবল স্মৃতির অলিন্দেই অস্তিত্বময়, আমরা যেন তা ঠাহর করে দেখি না। অথচ স্মৃতি নিয়েই ঘর করা, স্মৃতিতে পকেট ভরা। তবু বেখেয়ালে চেনা আধুলি হারিয়ে গেলে কী হয়? তখন থেকেই শুরু হয় ‘বেলাশুরু’র (Belashuru) মায়াবী আখ্যান।
‘বেলাশেষে’-র বিশ্বনাথ সরকার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) জীবনকে যে বৈচিত্র এবং বিস্তারে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, ‘বেলাশুরু’-র বিশ্বনাথ দাঁড়িয়ে থাকেন ঠিক তার বিপরীত অক্ষে। এখানে আর জীবন বাইরের দিকে ছুটতে চায় না, বরং যেন খুঁজে নিতে চায় দু-দণ্ড নিজেরই মুখোমুখি বসিবার অবকাশ; যে জীবনকে বিশ্বনাথ এককালে একঘেয়েই মনে করে এসেছেন, তাকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কারের পর ‘বেলাশুরু’-র গল্পের ভিতর তিনি যেন খুঁজে পান জীবনের প্রকৃত মর্ম। ‘বেলাশেষে’ জীবনকে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিল ঘরে-বাইরের দ্বন্দ্বে। ‘বেলাশুরু’ জীবনকে অনুভব করতে চাইল স্মৃতির বসবাস আর নির্বাসনে।
এ-গল্পে পৌঁছে তাই বিশ্বনাথ দেখেন স্ত্রী আরতির (স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত) স্মৃতির চৌকাঠ তিনি পার করতে পারছেন না কিছুতেই। আক্ষরিক অর্থে হয়তো তাঁর স্ত্রী অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত। স্ত্রীর স্মৃতি ফেরাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন বিশ্বনাথ। এই চেষ্টার ভিতর আসলে তো তিনি খুঁজতে থাকেন নিজেকেই। নিকটজনের স্মৃতি যাঁকে নির্বাসন দেয়, তিনি তো প্রকৃত অর্থে জীবন্মৃত। এই অসহায়তা যখন বিশ্বনাথকে স্পর্শ করে, তখন জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার।
সেই দ্রুত ধাবমান সময়ে কত কী বদলে গিয়েছে! বিশ্বনাথ-আরতির ছেলেমেয়েদের সম্পর্ক কোথাও জুড়েছে, কোথাও আবার স্পষ্টতর হয়েছে ফাটল। সময়ের অভিশাপ এসে পালটে দিয়েছে সম্পর্কের বয়ান। বিশ্বনাথ-আরতির সন্তান-সন্ততিরা সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে করতেই খুঁজে নিয়েছে জীবনের অভিজ্ঞান। সম্পর্ক একরৈখিক নয়। এক মাত্রার তালে তাকে বেঁধে ফেলতে গেলে ডানা ভাঙে। সে কথা হয়তো বোঝে পিউ, পলাশ, শর্মিষ্ঠা, বারীন, বিজন, মালশ্রীরা। সম্পর্কের নিরিখে সমস্যার রং বদলায় মাত্র। আর এই চরিত্ররা চিনতে পারে জীবন যেন সেই এক অচিনগাঙের নৌকাখানা, অনেক ঢেউয়ের উথাপাথাল সত্ত্বেও যেখানে দুজন সওয়ারীর ঠিক বসার জায়গা হয়ে যায়। আশা-নিরাশার দোলাচল পেরিয়ে এলে আর যেন ভয় থাকে না নৌকাডুবির। ছবিতে বিশ্বনাথের মেজ মেয়ে (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) সেই কথাটিই যেন বলে দেয়। অনেক সমীকরণ, অনেক হিসেব-নিকেশ পেরিয়ে জীবনের যে হারানো আধুলি কুড়িয়ে পাওয়া যায়, তা হল, বন্ধুত্ব। সম্পর্কের ডাকনাম যাই হোক, বন্ধুত্বই আসলে জ্বেলে রাখে দৃষ্টিপ্রদীপ।
এই অন্বেষণের সমান্তরাল চলে আর-এক খোঁজ। আরতি তাঁর স্মৃতিহীনতা নিয়ে আরও বেশি করে ঢুকে পড়েন স্মৃতির ভিতরেই। সে আসলে তাঁর শিকড় -ফরিদপুর, বাংলাদেশ, ইউসুফ, অতীন্দ্রদা তাঁর কাছে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘বেলাশেষে’র আরতি যে পরিচয় নিয়ে বেঁচে ছিল, বলা ভাল তাঁকে বেঁচে থাকতে হয়েছিল, ‘বেলাশুরু’-র আরতি তা অস্বীকার করেন নিরুচ্চারে। তিনি ফিরে যেতে চান তাঁর সত্যিকার পরিচয়ে। যে পরিচয়ের কাছে আমরা হয়তো সকলেই ফিরতে চাই। এই পরিচয় নির্মাণ করে ভালোবাসার জীবন। জীবন যেমন ভালবাসাকে খোঁজে, ভালবাসাময় এক জীবনের খোঁজই তো করছেন আরতি অথবা আমরা। সেটুকুই তাই সযত্নে স্মৃতিতে তুলে রেখেছেন আরতি। সেখানে তাঁর স্বামী আছেন গল্প হয়ে, অথচ বাস্তবের মানুষটি যেন সেই ছায়া স্পর্শ করতে পারছে না। বিশ্বনাথ তাঁর নিজেরই গল্পের কাছে হেরে যেতে থাকেন। এই সংকট শুধু তাঁর একার নয়, এর এক সার্বজনীন আদলও আছে, হয়তো এই সংকট সময়েরই। আর তার উপশমেই যেন আরতি পৌঁছাতে চান ভালবাসার জীবনের গল্পে। আরতির এই খোঁজ আর আরতির স্মৃতি-সূত্রে বিশ্বনাথের যে আত্মঅন্বেষণ, তাই-ই ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে ‘বেলাশুরু’র। এ ছবি তখন নেহাত আর পারিবারিক গল্প হয়ে থাকে না। বরং নিজেকে খোঁজা, অন্যের ভিতর দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার এই গল্প যেন আমাদের সম্মিলিত জীবনস্মৃতি হয়ে ওঠে।
নানা ভাবেই স্মৃতির পাতা ওলটাতে থাকে ‘বেলাশুরু’ (Belashuru)। আরও একবার বড় পর্দায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) এবং স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে (Swatilekha Sengupta) দেখার সুযোগ,স্পষ্টতই বাঙালিকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। এই যুগলবন্দির সাক্ষী আর তো হওয়া সম্ভব নয়। স্মৃতিহীন স্বাতীলেখার অসামান্য অভিনয়ের পাশে তাই যেমন নিশ্চুপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে, তেমনই উলটোদিকে সৌমিত্রর ওই মুখের রেখায় মনে মনে ভেঙে-পড়ার নির্বিকল্প অভিব্যক্তি যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কী সৌভাগ্যবানই না ছিলাম আমরা। আমাদের একজন সৌমিত্র এবং স্বাতীলেখা ছিলেন। তাঁদের দেখতে দেখতে হয়তো কারো মনে পড়বে ‘অজ্ঞাতবাস’ নাটকটার কথা, সেখানেও খানিক স্মৃতি হারিয়ে ভুল দরজায় কড়া নেড়েছিলেন স্বাতীলেখা। অথবা ‘হারানো সুর’ ছবিটির কথাও মনে আসে, যেখানে উত্তম-স্মৃতি ফিরিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। তবে ‘বেলাশুরু’-র কাহিনি যে স্মৃতিহীনতার কথা বলে, যে পরিচয় খোঁজার কথা বলে, সৌমিত্র-স্বাতীলেখা যুগলবন্দিতে তা বহুকাল মনে রাখবেন বাংলা ছবির দর্শক। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত (Rituparna Sengupta), অপরাজিতা আঢ্য (Aparajita Adhya), খরাজ মুখোপাধ্যায় (Kharaj Mukherjee), মনামী ঘোষ (Monami Ghosh), ইন্দ্রাণী দত্ত (Indrani Dutta), শংকর চক্রবর্তী (Shankar Chakraborty) প্রমুখ এবং স্বল্প পরিসরে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত (Rudraprasad Sengupta) এবং কৌশিক সেন (Kaushik Sen)- তাঁদের চরিত্রগুলোকে এতখানি বাস্তবানুগ করে তুলেছেন যে, এই পরিবারটাকে যেন সিনেমার পরিবার বলে মনেই হয় না। আর ‘টাপা টিনি’র জন্য তো দর্শক অধীর আগ্রহে অপেক্ষাই করছিলেন।
এ ছবি জীবনকে পরিচর্যার কথা বলে। বলে সম্পর্কহীনতার শূন্যতা থেকে বন্ধুত্বে পৌঁছানোর কথা। আসলে এ ছবি যেন বলতে চায় সমে ফেরার কথাটাই। বিশ্বনাথ স্ত্রীর স্মৃতিতে নিজেকে খুঁজে পেলেন কি-না, আরতি তাঁর শিকড়কে চিনতে পারলেন কি-না, এইসব উত্তর তাই শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে না। শেষবেলায় তাই জোনাকির মতো জ্বলে ওঠে দুটি শব্দ – পরমআদর আর চুপচাপ। পরস্পরের সম্পর্ক শুধু এটুকুই চায়। এই দুই শব্দের অভিঘাত তাই দর্শককে স্তব্ধ করে। জীবন আর জীবনের মর্মের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দর্শক টের পান, ‘বেলাশুরু’ সিনেমাটা আসলে শেষ হয় না। তা পুনরায় শুরু হয় প্রতি দর্শকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিতর।
এই পর্বে ছবির আবহ তাই বিষাদ নয়, একরকমের উদযাপনকেই স্পর্শ করে। পরিচালক নন্দিতা রায় (Nandita Roy) এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Shiboprosad Mukherjee ) ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকলেন, এমন একটি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য, যা সাধারণ গল্পের আড়ালে আড়ালে বাঙালি দর্শককে ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজেকে চেনার আরশিনগরে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজস্ব অভিজ্ঞতা, স্মৃতি আর সত্তা আর সম্পর্কের কাছে। সম্পর্কের যে প্রবহমানতা ছুঁয়ে থাকতে চায় এ ছবি, তাতে ‘বেলাশেষে’-র পর একটা ‘বেলাশুরু’ থাকে বটে, তবে ‘বেলাশুরু’র আর কোনও বেলাশেষ থাকে না।
বেলাশুরু
পরিচালনা – নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অপরাজিতা আঢ্য, খরাজ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ|
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.