ভালবাসার যেমন জাত-পাত-ধর্ম হয় না, তেমন কোনও লিঙ্গও হয় না। সমকামী প্রেমকে সুপ্রীম কোর্ট অনেক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু বর্তমানেও কি মফঃস্বলের সমকামপ্রেমীরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তে পারে? কিংবা সমাজ তথা পারিবারিক লাঞ্চনা-বঞ্চনার মাঝে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়েও মুক্তির স্বাদ নিতে পারে? সেই প্রশ্ন তুলেই মুক্তি পেল আয়ুষ্মান খুরানার ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’। লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
পরিচালক- হিতেশ কৈবল্য
অভিনয়ে- আয়ুষ্মান খুরানা, জিতেন্দ্র কুমার, নীনা গুপ্তা, গজরাজ রাও
না, ‘ইয়ে’ নয় ‘গে’!…
সমকামিতা ‘সামাজিক বিষফোঁড়া’? শরীরী খাঁজে হিল্লোল তোলা পুরুষ দেখলে কিংবা কোনও সমলিঙ্গ দু’জনকে আমরা যখন রাস্তায় হাত ধরে যেতে দেখি, এই প্রশ্ন কিন্তু অনেকের মনেই উঁকি দেয়। ওদের দেখলে চারদিক থেকে হওয়া ফিসফাস-বাঁকা কথাগুলিকে কিন্তু এখনও আমাদের সমাজে স্বাভাবিক বলে মনেই করা হয়। কিন্তু সমকামিতাও যে অস্বাভাবিক কিছু নয়, আর পাঁচটা বিষয়ের মতোই স্বাভাবিক, সেই চিন্তাধারা আমাদের সমাজে এখনও গ্রাহ্য নয়! তাই বোধহয় পুরুষ-পুরুষে হাত ধরাধরি, গা ঘেঁষাঘেঁষি দেখলে আজও ‘ম্যা-গো..’ বলে আওয়াজ ওঠে। ভালবাসার কি সত্যিই কোনও লিঙ্গ হয়? ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’ আরও একবার মনে করিয়ে দিল।
বলিউডে সমকাম রোম্যান্স
সমকামিতা নিয়ে বলিউড হয়তো ইদানিং উদারতা দেখিয়েছে। তবে, বলিউডকে প্রথম সমকাম বা সমলিঙ্গ প্রেমের সঙ্গে পরিচয় করান পরিচালক দীপা মেহেতা। সালটা ১৯৯৬। পরিচালক দীপা বড়পর্দায় দুই জা- শাবানা আজমি এবং নন্দিতা দাসের সমকাম প্রেম দেখিয়েছিলেন। সমাজ কিন্তু তখনও এতটা উদার চোখে দেখত না এই সম্পর্ককে। তবে, তারপর থেকে বহু পরিচালকের হাত ধরেই বারবার এই সমকাম রোম্যান্স হয়ে উঠেছে তাঁদের ছবির বিষয়বস্তু। আধুনিক প্রেক্ষাপটে সেরমকমই এক মিষ্টি প্রেমকাহিনি ‘শুভমঙ্গল জ্যাদা সাবধান’। গল্পের নায়ক-নায়িকা দু’জনেই পুরুষ। পুরুষ-পুরুষের অনস্ক্রীন চুম্বন, রসায়ন সবই রয়েছে এই ছবিতে।
সমকামী আয়ুষ্মান
আচ্ছা বিশ্ব যত ভালবাসার গল্প বুনেছে, তাতে কেন নারীর প্রেমেই পড়তে হবে একজন পুরুষকে? হির-রাঞ্ঝা, রোমিও-জুলিয়েট, ল্যায়লা-মজনু, আজন্মকাল ধরে এই জুটিরগুলোর উদাহরণই তো আমরা শুনে এসেছি কিংবা শোনানো হয়েছে। ব্রাত্য থেকে গিয়েছে সেই নামগুলো যারা সমলিঙ্গের প্রেমে পড়েছেন। কেন? সমাজের মুখে গভীর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন কার্তিক (আয়ুষ্মান)। এখনও যে আমাদের সমাজ খুব একটা উদার তা কিন্তু নয়! কারণ, বাইরে সমকামিতা নিয়ে যতই বুলি আওড়ানো হোক না, পারিবারের সদস্য সমকামী হলে সেক্ষেত্রে উদারতার উদাহরণ খুব কমই দেখা যায় চারপাশে। বাবা-মা হোক কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে রোজ যুঝে ওঠাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আয়ুষ্মান খুরানার সংলাপে কিন্তু বারবার এই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। আয়ুষ্মান খুরানার অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। বারবার ছবির চরিত্রের প্রয়োজনে নিজেকে ভেঙেছেন। কখনও গম্ভীর পুলিশ অফিসার, কখনও অন্ধ পিয়ানোবাদকের চরিত্রে আবার কখনও বা কমবয়সি টেকো পুরুষের সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছেন। এবারেও তাঁর অভিনয় নিরাশ করেনি। তবে ‘গে’ ইমেজটা এস্টাবলিশ করার জন্য নোজরিং পরা খানিক বোকা বোকাই মনে হয়েছে।
কমেডির মোড়কে হারাল ক্রাইসিস
মানসিক যন্ত্রণা, আপনজনের সঙ্গে দূরত্ব-লড়াই, যেসমস্ত ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, আয়ুষ্মান খুরানার ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’ সেই প্রত্যেকটা স্তরই ছুঁয়ে গিয়েছে। তবে খানিক অগভীরভাবেই। সমকাম প্রেমের মতো একটা ইস্যুকে কমেডির মোড়়কে এতটাই আষ্টেপিষ্টে মোড়া হয়েছে যে বাস্তব ক্রাইসিসগুলোই কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে! এই জায়গায়গুলোয় আরেকটু যত্ন নিতে পারতেন হিতেশ। জিতেন্দ্র কুমারের অভিনয়ে আরও একটু শাণ দিলে ভাল হত। আবেগ-অনুভূতিগুলো কিছু জায়গায় ফুটিয়ে তুলতে অপারগ। নীনা গুপ্তা কিংবা গজরাজ রাও প্রত্যেকবারের মতো এবারেও তরলের মতো পাত্রে যথাযথ এঁটে গিয়েছেন।
কেন দেখবেন?
সমকাম রোম্যান্স বলিউড এর আগেও দেখেছে, কিন্তু এই সিনেমার জোরে কি নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করার সাহস জোগাড় করতে পারবেন সমকামীরা? সেই প্রশ্ন রেখেই একবার দেখেই আসতে পারেন ‘শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান’। কিন্তু একটা কথা বলাই যায় পারিবারিক গল্পের মোড়কে ‘গে লাভস্টোরি’ এর আগে এরকম স্বচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দেখানো হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.