বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়: একটা সিনেমা, নাকি একটা ইস্তাহার! একটা ছায়াছবি, নাকি সময়ের ভিতর ঘনিয়ে-ওঠা অন্য এক আকাশ! অরিত্র মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ফাটাফাটি’ (FataFati) ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হল, এ যেন সাক্ষাৎ ‘প্যারাডক্স’। যে-সিনেমা এযাবৎ মহিলাদের সৌন্দর্যের পুরুষনির্মিত টেমপ্লেট ফেরি করে বেরিয়েছে অন্ধকার হলে হলে, সেই সিনেমাই আলো হয়ে উঠল মহিলা মহলের এমন নিজস্ব বয়ানে।
নারীসৌন্দর্যের যে বাঁধাধরা ধারণা, তা যে পুরুষতন্ত্রেরই একটা অসম্ভব নির্মাণ, এ-কথা তো অস্বীকারের উপায় নেই। ‘মেইল গেজ’ ঠিক করে দেয় নারী শরীরের মানচিত্র। মাপে মাপে বাঁধা সেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি। একটু এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। তাহলেই মার্কশিটে লাল দাগ। এই চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আজ কতকাল ধরে নাকাল-নাজেহাল হয়েছে নারীরা। আর তাতে সমানে উৎসাহ জুগিয়ে গিয়েছে বিনোদনমূলক সিনেমাই। সেখানে নায়িকাদের যে সাধারণ নির্মাণ, তা যে পুরুষচক্ষু সার্থক করতেই সৃষ্টি তা প্রায় সকলেই জানেন। এখানে ‘পুরুষ’ বলতে অবশ্য আমি কেবল লিঙ্গপরিচয়ভিত্তিক পুরুষের কথা বলছি না। বলছি, এক বিশেষ মানসিকতার কথা। সে মানসিকতার শিকার, দুর্ভাগ্যজনক হলে, অনেকসময় খোদ নারীরাও। ঋতাভরী-আবিরের ‘ফাটাফাটি’ সেই ধারণা থেকেই সচেতন বেরিয়ে আসার এক অনবদ্য প্রয়াস।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, স্থূলকায়ার দরুণ কী জ্বালা সহ্য করতে হয় নারীদের। যেন এ কোনও অভিশাপ! অথচ তা তো হওয়ার কথা ছিল না। অচেনা মানুষের কথা ছেড়েই দিলাম; চেনা, এমনকী কাছের মানুষদের কাছেও এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যই যেন একজন নারীর প্রধান পরিচয় হয়ে ওঠে। সে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে নিজস্ব মেধায় এ-সমাজে যে স্থানই অর্জন করুন না কেন, সমস্তটার উপর ঘুরেফিরে ছায়া ফেলে ওই কায়া-ই। এ অলাতচক্র থেকে যেন নিষ্ক্রমণ নেই। আজও তো পাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপনে তন্বী শরীরই খুঁজে ফেরে আমাদের প্রগতিশীল সমাজ। খবরে দেখায়, স্লিম হওয়ার জন্য নায়িকারা কী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। সেই ছিপছিপে চেহারার জন্য তোলা থাকে প্রশংসার গোলাপগুচ্ছ। আর, এসব থেকে দূরে যে নারী, তিনি তাহলে কী নিয়ে থাকেন! তাঁর জন্য থাকে একরাশ অবসাদ, হতাশা। কখনও সখনও তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। বিশেষত, অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে। ঠিক সেই জায়গা থেকেই ‘ফাটাফাটি’ একটি চমৎকার ফাটাফাটি থাপ্পড় হয়েই ধরা দেয় আমার কাছে।
সুখের কথা এই যে, সময়টার ভিতর যে বদলের ঢেউ, তা টের পাওয়া যাচ্ছে শিল্পমাধ্যম এবং অন্যত্রও। কিছুদিন আগেই ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন করতে অস্বীকার করেছেন এক নায়িকা। ব্যান্ড এইড-এর স্কিন টোন ম্যাচ করার যে অযৌক্তিক চেষ্টা, তা নিয়ে সমালোচনা চলেছে নেটদুনিয়ায়। এরকম একটা সময়ে বাংলা ভাষায় যে ‘ফাটফাটি’-র মতো একটা সিনেমা হচ্ছে, তা আমাদের আশ্বস্ত করে। বরং বলা ভাল, সময়ের দাবিতে এ-সময়ে এমন ছবি হওয়াই উচিত। অনেকগুলো নারীকে এ-ছবিতে আমরা দেখি, যাঁরা সমাজের চেনা মাপকাঠিতে স্থূলকায়। তাঁদের সমস্যা আছে, জীবনের ওঠা-পড়া আছে।
তবু এ-গল্পের উড়ান ফিতেয়-মাপা ওই শরীরী ধারনার বাইরে। তাঁরা প্রত্যেকে খুঁজে নিচ্ছেন তাঁদের নিজের পরিচয়। এইটেই তো জরুরি। যা বহুদিন আগেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সৌভাগ্যের কথা দেরিতে হলেও তা হচ্ছে। সিনেমা কি সামাজিক দায় পালন করে যাবে? এ-প্রশ্ন নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তবে এই ছবি যেভাবে সমাজের মন বদলকে স্বীকৃতি দিল তার গুরুত্ব অনেকখানি। হয়তো আগামীতে, এমন দিন আসবে যেখানে এই অনর্থক আলোচনা আর প্রয়োজনই হবে না। সেই পরিবর্তনের সলতেখানা যেন পাকিয়ে দিল ‘ফাটফাটি’।
সমাজের কথা বলতে গিয়ে সিনেমা যে তার অন্য দিকগুলিতে অবহেলা করেছে, তা কিন্তু একবারের জন্যও মনে হয়নি। পরিচালক আর কলাকুশলীদের মুনশিয়ানায় এক মুহূর্তের জন্যও ক্লান্তি আসেনি। মনে হয়নি যে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বরং সময় যত গড়িয়েছে, তত মনে হয়েছে এটাই তো স্বাভাবিক।
‘ফাটাফাটি’র এই সহজ অথচ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার নেপথ্যে পরিচালকের পাশাপাশি অনেককানি কৃতিত্ব প্রাপ্য জিনিয়া সেন ও সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এ ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ তাঁদেরই। ঋতাভরী চক্রবর্তীর (Ritabhari Chakraborty) সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্বচরিত্রে স্বস্তিকা দত্ত (Swastika Dutta), দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের প্রাণবন্ত অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি। আলাদা করে বলতে হয়, আবির চট্টোপাধ্যায়ের (Abir Chatterjee) কথা। ওঁর চরিত্রটি নিয়ে বিশদে বলছি না, দর্শক দেখলে বুঝবেন। তবে ওরকম একটা চরিত্র যে দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আবির, তা বহুদিন মনে থেকে যাবে।
ছবিতে ফুল্লরা চরিত্রটি বলে ওঠে, যে, “মোটামুটি নয় এখন সকলের জীবন ফাটফাটি” – তাই-ই যেন আগামীর স্লোগান হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার প্রত্যাশা সেটাই। আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের জন্য শুধু একটা কথাই বলতে পারি শেষপাতে- বস্ ফাটাফাটি!
সিনেমা – ফাটাফাটি
অভিনয়ে – ঋতাভরী চক্রবর্তী, আবির চট্টোপাধ্যায়, স্বস্তিকা দত্ত, দেবশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, সোমা চক্রবর্তী প্রমুখ
পরিচালনায় – অরিত্র মুখোপাধ্যায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.