এখনই বইকে ছাপিয়ে ই-বই। তা হলে ১০ বছর পর দু’মলাট ঘিরে জমজমাট মেলা বসবে কী করে? মতামত শুনল কফিহাউস।
অক্ষরের প্রলোভন সুন্দরী রমণীর মতো
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (লেখক)
২০২৯-এও বইয়ের অস্তিত্ব থাকবেই থাকবে। কারণ বইয়ের একটা আলাদা চার্ম রয়েছে। এই তো ক’দিন আগে দিল্লির সাহিত্য আকাডেমি আর আরও বেশ কিছু বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ালাম। একবার এয়ারপোর্টের বইয়ের দোকানেও ঢুঁ মারলাম। হার্ডকভার, সফ্টকভার, দামি, নামী কত কী যে দেখলাম বইয়ের চেহারায়! দেখতে না দেখতে পাঁচ-ছ’হাজার টাকার ক্যাশ মেমো তৈরি হয়ে গেল। শেষে নাতনি, সে সঙ্গে ছিল, সে-ই হাত ধরে টেনে বার না করলে কী যে হত কে জানে! ইলেকট্রনিক্সের বই হল বইয়ের ভূত। তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, বুকে জড়ানো যায় না, বুকে ধরে শোয়া যায় না। পিঠে বালিশ লাগিয়ে শুয়ে পড়া যায় না। আর ছাপা বইয়ের অক্ষরের যে কী প্রলোভন। অক্ষরের প্রলোভন সুন্দরী রমণীর প্রলোভনের চেয়ে কিছু কম না! বরং আরও সাংঘাতিক। সহজেই মানুষকে চরিত্রহীন করে তোলে। ই-বই পড়তে হলে যে কাচের সামনে পিঠ সোজা করে টানটান হয়ে বসতে হবে, পাতা ওল্টানোর বদলে চেলে চেলে পড়তে হবে, হঠাৎ করে জ্বলজ্বল করে ফোটা পাতা ভ্যানিশ হয়ে গেলে ফের কসরত করে ডেকে আনো- সত্যিকারের পাঠকের কি এসব পোষায়! বই হবে বউয়ের মতো। বাড়ির বউ, সঙ্গিনী যেমন। প্রদীপের আলোয় বসেও নিরিবিলিতে পড়া যাবে। একটা আধ্যাত্মিক ভাব যেন। এই নিবিড় পাঠ কোত্থেকে দেবে ইলেকট্রনিক্সের কাচের কেতাব!
প্রাসঙ্গিক থাকবে
চিকি সরকার (কর্ণধার, জাগারনট পাবলিকেশনস)
আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। কিন্তু যদি প্রেডিক্ট করতেই হয়, তা হলে বলব, এখন যে ভাবে বইমেলা চলছে তার ভিত্তিতে দশ বছর পরেও বইমেলা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক থাকবে।
আজীবনের উত্তেজনা
সন্দীপ রায় (পরিচালক)
আমাদের সময়ে বইমেলা হত ময়দানে। যাওয়া-আসার সুবিধে ছিল। সারা দিন ধরে চলত বই আবিষ্কার পর্ব। দেশ-বিদেশের প্রকাশনা সংস্থা সেখানে ভিড় করত। আর আমি অপেক্ষায় থাকতাম বইমেলার শেষ দিনের জন্য। মাঠের মাঝখানে বড় শতরঞ্চি পেতে ঢেলে সাজানো হত বই। খুব কম দামে বিক্রি হত বইগুলো। তখন আমি তিন-চারশো টাকার বই কুড়ি-পঁচিশ টাকাতেও কিনেছি। এখন আর এ রকম হয় কী না, জানি না। কারণ অসুস্থতার কারণে বইমেলায় যাওয়া হয়ে ওঠে না। বইমেলার শুরুর দিকের সময়ে বাবা খুব যেতেন। বাবাকে ঘিরে তখন বইপ্রেমীদের ভিড়! বাবার এত অসুবিধে হত যে নিশ্চিন্তে বই দেখতে পারতেন না। তাই প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে মেলা থেকে বই আনিয়ে নিতেন। আমার মনে হয়, বইমেলা নিয়ে বইপ্রেমীদের উত্তেজনা আজীবন থেকে যাবে। তবে হ্যাঁ, আজকাল উত্তেজনা একটু কম দেখি। নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়া কিংবা পাতা ওলটানোর সেই আনন্দ বোধহয় আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এখন তাদের হাতে আইপ্যাড, কিন্ডল। ধুলোভরা মাঠে হেঁটে বই কেনার উন্মাদনা কম। ২০২৯-এ বইমেলার প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন উঠলে ভীষণ খারাপ লাগবে। বিদেশে বড় প্রকাশক সংস্থাগুলো প্রায় উঠেই গেছে। কিন্তু এ দেশে এখনও মানুষ বই কিনছে এবং বই পড়ছে- এটাই আমাকে অনেকটা স্বস্তি দেয়।
[ ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি শেষ করে দিয়েছেন রহমান’, ফের বিতর্কিত মন্তব্য অভিজিতের ]
থেকে যাবে
শুভঙ্কর দে (কর্ণধার, দে’জ পাবলিশিং)
বই যদি থাকে, তাহলে মেলাও থাকবে। ভবিষ্যতের কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারে না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ২০২৯ সালে বইমেলা বহাল তবিয়তেই থাকবে। এই মুহূর্তে রাজ্যে প্রায় ৪০০ বইমেলা হয়। বইয়ের কদর যদি না থাকে, বই পড়ার লোক যদি না থাকে, বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা যদি না-ই থাকে, তবে এতগুলি বইমেলা রমরমিয়ে হচ্ছে কী করে? দশ বছরের ব্যবধানে মেলার সংখ্যা আরও বাড়লে অবাক হব না। একটা কথা প্রায়ই শুনতে হয়। ‘কিন্ডল’-এর সঙ্গে কি বই ফিজিক্যালি পাল্লা দিতে পারবে? সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বিদেশে ‘কিন্ডল’-এর পপুলারিটি গ্রোথ আগের চেয়ে কমেছে। মানুষ হার্ডবাউন্ড বা পেপারব্যাক বইয়ে আস্থা রাখছেন। ভারতেও ফিজিক্যালি বইয়ের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বাংলা ভাষা মরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। বাংলা ভাষা হেসেখেলে টিকে থাকবে। বইও থাকবে।
বই বিক্রি কোথায়
বুদ্ধদেব গুহ (লেখক)
২০২৯! সে তো দশ বছর পরের ব্যাপার। তখন কোথায় আমি! বইমেলা, কলকাতার বইমেলা, এখনই কি রেলিভ্যান্ট আছে? অন্য মেলাগুলির মতো বইমেলাও এখন হুজুগ। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। কিন্তু সে তো খাওয়া-দাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, পিকনিকের ভিড়। যতো ভিড় হয় ততো তো বই বিক্রি হয় না। তাছাড়া, ওটাকে কলকাতার বইমেলাই বা বলি কী করে? প্রপার কলকাতায় তো আর বইমেলা হয় না। কতদূরে মেলা হয় বল তো? দ্যাখো আমি বলছি না যে বইয়ের রেলিভ্যান্স কমছে। কিংবা সাহিত্যের মূল্য কমে যাচ্ছে। ওটা চিরদিন থাকবে। দশ বছরে কোনও পরিবর্তনই হবে না। কিন্তু এখন তো অনলাইনে বই পড়াও যাচ্ছে, বই বিক্রিও হচ্ছে। সুতরাং দশ বছর পরে বইমেলার কোনও অর্থই থাকবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া, গিল্ড তো এখন মাত্র কয়েকটি পাবলিশারের মৌরসিপাট্টা। তারাই জাঁকিয়ে গিল্ডের সর্বেসর্বা। নতুন মেম্বার হতেই দিচ্ছে না। গিল্ড যেভাবে চলছে, তাতে ডেমোক্র্যাসি কোথায়? গিল্ড এখন কয়েকটি প্রকাশকের ব্যবসা হয়ে গেছে। তাতে সাহিত্যের ইন্টারেস্ট কোথায়? বরং এই বইমেলা গ্রন্থসংস্কৃতির ক্ষতিই করছে। সত্যিকারের সাহিত্যবোধের সর্বনাশ করছে। তবে একটা বড় সান্ত্বনা যে এখনও আনন্দ, শিশুসাহিত্য সংসদ এবং সুবর্ণরেখার মতো প্রকাশকরা আছেন। এঁরা সত্যিই অনেস্ট প্রকাশক। আমি খুব মিস করি সুবর্ণরেখার কর্ণধার ইন্দ্রনাথবাবুকে। ওঁর চলে যাওয়ার ক্ষতি অপূরণীয়।
কিন্ডল থাকবে তার জায়গায়
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় (সাধারণ সচিব, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড)
তেতাল্লিশ বছর আগে যখন বইমেলা শুরু হয়েছিল, লোকে বলেছিল এ রকম মেলা চলতেই পারে না। সেখানে বইমেলা শুধু চলেইনি, আকারেপ্রকারে এতটাই বেড়ে উঠেছে যে ক্রমশ বড় জায়গায় স্থানান্তর করতে হয়েছে। রবীন্দ্র সদন থেকে পার্ক স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট থেকে ময়দান। বিধাননগরেও প্রচুর ভিড় হয়। আসলে বইমেলা এমন একটা আর্থসামাজিক উৎসব, যাতে সবাই অংশ নিতে চায়। দশ বছর কেন, আগামী তিরিশ বছরেও বইমেলার প্রাসঙ্গিকতা কমবে না। যতদিন বই থাকবে, বইমেলাও থাকবে। কিন্ডল তার নিজের জায়গায় থাকবে, বই তার নিজের জায়গায়। ষোলো ঘণ্টার ফ্লাইটে লোকে কিন্ডল পড়বে। কিন্তু নিজের বাড়িতে সে বই-ই বেছে নেবে। কারণ আমাদের দেশে রকেট যেমন আছে, গরুর গাড়িও আছে।
[ করণের সঙ্গে বন্ধুত্বের ফল হতে পারে মারাত্মক! কেন জানেন? ]
কদর বাড়বে
সবিতেন্দ্রনাথ রায় (ভানুবাবু) (কর্ণধার, মিত্র ও ঘোষ)
দশ বছর পরে ২০২৯ সালেও কলকাতা বইমেলা হবে। উপরন্তু বাংলা বইয়ের কদরও উত্তরোত্তর বাড়বে বলে আমি মনে করি। এত সংখ্যক মানুষ বাংলায় কথা বলেন। বাংলা ভাষার বিলোপ তাই হবে না। বাংলায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, বাংলা পড়ার আগ্রহও তত থাকবে। বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর বাংলা ভাষা যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে, তার অবনমন ঘটবে বলে মনে করি না।
কেউ বই পড়বে না
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় (লেখিকা)
বই এখনই কেউ পড়ে না। দশ বছর পর তো কেউ পড়বে বলে মনেই হয় না। যা দেখার যখন চোখের সামনে দেখেই নিতে পারছি তখন আর শব্দের মায়াজালে জড়াতে যাব কেন? সমুদ্রের তলায় একটা মাছ ঘুরে ঘুরে আলপনা দেয়। এর বর্ণনা আর কেউ কেন পড়বে? যখন চোখের সামনে একটা ক্লিক করলেই সেই আলপনা নকশাসুদ্ধু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে যে সব আবেগ, অনুভূতির পিকচারাইজেশন হয় না, সে সব নিয়ে লিখলে মানুষ পড়লেও পড়তে পারে। সমস্যাটা সেটাও ছিল না। হঠাৎ সোশ্যাল মিডিয়া যে ভাবে লেখক তৈরি করল, আর তাদের সে সব লেখা বই হতে লাগল, আর ছেয়ে গেল আমাদের সাহিত্যের বাজারে, সেটাও সাহিত্যের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিল আর কী। এত জঘন্য, অন্তঃসারশূন্য লেখার মধ্যে একটা ভাল লেখা খুঁজে পাওয়াটাও তো একটা অতিরিক্ত পরিশ্রমের কাজ। অত কার দায় পড়েছে? আমার খুব দুশ্চিন্তা। কি হবে এই এত এত বইয়ের? একজন লেখক হিসেবে, একজন প্রকাশক-বই ব্যবসায়ীর স্ত্রী হিসেবে এই ভাঙা হাটের, ভাঙা মঞ্চের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি তো! খারাপ লাগে।
[ জীবনের ব্যস্ততায় বদলে গিয়েছে বাঙালির পিকনিক ]
ছবি: শুভাশিস রায়
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.