বিশ্বদীপ দে: ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান’। লিখেছিলেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore)। ভানুসিংহের ছদ্মনামে ‘মরণ’ কবিতায় মৃত্যুর অনুষঙ্গে ‘শ্যাম’ তথা প্রেমকে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কর্কশতাকে অনুভব করতে হয়েছিল তাঁকে। মৃত্যুর মাঝে অনন্তের প্রবাহকে খুঁজে ফিরলেও আপনজনদের হারানোর শোক যে তাঁকেও আকুল করেছিল, তা বোঝা যায় তাঁর প্রেতচর্চার অভ্যাসের দিকে ফিরে তাকালে।
তবে একথাও ঠিক, কম বয়স থেকেই প্ল্যানচেটের (Planchette) অভ্যাস ছিল রবীন্দ্রনাথের। শোনা যায় কিশোর রবির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল সদ্যমৃত মাইকেল মধুসূদন দত্তের। এরপর, কুড়ি-একুশ বছর বয়সে ফের প্ল্যানচেট করা শুরু করেন তিনি। কিন্তু সেবারের আসর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কেননা অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথ আচমকাই মারা যান।
এর প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে আটষট্টির প্রৌঢ় রবীন্দ্রনাথ এক ‘মিডিয়ামে’র সংস্পর্শে আসেন। মিডিয়াম অর্থে প্রেতচক্রে ডাক পাওয়া আত্মা যার দেহে ভর করে বা অন্যভাবে যার মাধ্যমে যোগাযোগ করে বাকিদের সঙ্গে। কবির বন্ধু ও বহু কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা দেবী ছিলেন সেই মিডিয়াম। তরুণী বুলার (উমা দেবীর ডাকনাম) মধ্যে এই বিশেষ ক্ষমতার কথা জানতে পেরে নতুন করে রবীন্দ্রনাথ কৌতূহলী হন প্রেতচর্চায়।
তবে সেকথায় আসার আগে একটু বলা দরকার বাংলার প্রেতচর্চার এই ইতিহাস সম্পর্কে। যার সঙ্গে গাঢ় সম্পর্ক রয়েছে ঠাকুরবাড়িরও। ১৮৬৩ সালে প্রথম প্রেতচক্র অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। আয়োজক প্যারীচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুর। এরপর পূর্ববঙ্গের যশোরেও এক প্রেতচক্র তৈরি হয়। সেখানে আসতেন দীনবন্ধু মিত্র ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ একাই নন, সেযুগের চিন্তনবিদরা অনেকেই উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন প্ল্যানচেটের বিষয়ে। ১৮৮০ সালের নভেম্বরে স্থাপিত হয় বাংলার একমাত্র প্রেততাত্ত্বিক সমিতি ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অফ স্পিরিচুয়ালিস্ট’। যা বুঝিয়ে দেয় সেকালের বাংলায় প্ল্যানচেট কীভাবে জনপ্রিয় উঠেছিল।
এই চর্চার ছায়া এসে পড়েছিল ঠাকুরবাড়িতেও। ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথও যার শরিক হয়ে পড়েছিলেন। একটি যন্ত্র সেই সময় বেশ চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ যার নাম দিয়েছিলেন ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’। এই যন্ত্রের সাহায্যেই কিশোর কবির সাক্ষাৎ হয়েছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের। প্রমথনাথ বিশিকে লেখা এক চিঠিতে যার উল্লেখ করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি তাঁকে দেখিনি, একবার প্রেতবাণী চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা আদালতে সাক্ষ্যরূপে গ্রাহ্য হবে না।’’ জীবনস্মৃতি’-তেও সেই সব প্ল্যানচেটের উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
কিন্তু তারুণ্যের প্রথম দিনগুলির পরে দীর্ঘ সময়ে আর প্রেতচর্চায় আগ্রহী হতে দেখা যায়নি রবীন্দ্রনাথকে। আবার সেই সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে ১৯২৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতনের উদয়ন ও জোড়াসাঁকোয় ফের প্ল্যানচেটে বসলেন প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ। আগেই বলেছি, যার পিছনে ছিল বুলা দেবীর সাক্ষাৎপ্রাপ্তি। প্রশান্ত মহলানবীশ, নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী, মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষরাও ছিলেন কবিগুরুর সঙ্গী। প্রায় মাসদুয়েক সময়কালে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়েছিল বহু চেনা মানুষদের সঙ্গে। সেই তালিকায় যেমন ছিলেন আত্মীয়স্বজনরা। তেমনই ছিলেন প্রিয় বন্ধুরাও। অমিতাভ চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’র মতো বই থেকে জানা যায়, সেই সব সাক্ষাৎ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল মোটা খাতায়। ওই খাতা থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁর ‘নতুনদা’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ, প্রিয় ভাইপো বলেন্দ্রনাথ ও হিতেন্দ্রনাথ, স্ত্রী মৃণালিনী, বড় মেয়ে মাধুরীলতা, ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ। এসেছিলেন তাঁর ‘নতুন বউঠান’ও। কিন্তু তিনি তাঁর পরিচয় দেননি। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিঃসংশয় ছিলেন, তিনিই এসেছেন। কেবল আত্মীয়রাই নন, অনুজপ্রতিম সুকুমার রায় থেকে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রিয় পাত্ররাও এসেছিলেন সেই প্রেতচক্রের আহ্বানে। আসলে উমার হাতে থাকত কাগজ পেনসিল। আত্মার সব কথা তিনি লিখে চলতেন প্ল্যানচেট চলাকালীন।
কী ধরনের কথা হয়েছিল প্রেতচক্রের ‘অশরীরী’ অতিথিদের সঙ্গে? দেখা যাচ্ছে, সাধারণ কথাবার্তা যেমন হয়েছিল, তেমনই কথা হয়েছিল মৃত্যুর পরে জীবাত্মা কোনও পরিবেশ ও জগতের মধ্যে অবস্থান করে, তাদের মানসিক অবস্থা কেমন থাকে তা নিয়েও। যেমন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ”মৃত্যুর পরমুহূর্তে পরলোকের সঙ্গে সম্বন্ধ কী উপায়ে হয়?” উত্তর এসেছিল, ”সে একটা আচ্ছন্ন ভাবের ভিতর দিয়ে আসি। ঠিক যেন ঘুম থেকে জাগি। সমস্ত জীবনটা গত রাত্রের স্বপ্ন বলে মনে হয়।” আবার তিনি যে তিনিই, সেই ‘প্রমাণ’ দিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন দু’লাইনের কবিতা- ”আমার আজও কিরে, সেই আবরণ আছে রে।/ এ যেন কোন অজানা পথ, শেষ নাহি রে।” বাদ যায়নি একেবারে ‘সাংসারিক’ প্রসঙ্গও। সুকুমার রায় কবিগুরুকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর ছেলেকে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে নেওয়ার জন্য। এদিকে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করেছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিয়ে নিয়েও।
একটা কথা মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের কম বয়সের প্ল্যানচেটে কৌতূহলই ছিল প্রধান কারণ। কিন্তু পরিণত বয়সের এই প্রেতচর্চায় এক অন্যতম কারণ ছিল হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ফের সংযোগসাধনের তীব্র ইচ্ছে। সারা জীবনে অসংখ্য মৃত্যু, অজস্র বিচ্ছেদ সইতে হয়েছে তাঁকে। যা বারবার তাঁর সৃষ্টিতেও ফিরে ফিরে ছায়া ফেলেছে। সেই একই অভিপ্রায়ই তাঁকে প্রেতচক্রেও বসতে বাধ্য করেছে। এই অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ”ব্যাপারখানা ঠিক কী তা জোর করে বলতে পারিনে। মনে হল যেন ভিন্ন ভিন্ন লোকের সঙ্গেই কথা কওয়া হল। সন্দেহ মাত্র নেই বুলার ভাষা নয় ভাবও নয়- আমারও নয়।” মিডিয়াম বুলা, যিনি নিজেও মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা যান, তাঁর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্ন, ”ও কেন মিছে বলবে? কী লাভ ওর ছলনা করে? এমন সব কথা বলেছে যা ওর বিদ্যাবুদ্ধিতে সম্ভব নয়।… আমি কী প্রশ্ন করব তা তো আর ও আগে থেকে জানত না যে প্রস্তুত হয়ে আসবে।”
এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অন্ধ বিশ্বাস না করে নিজের মতো করে যুক্তি সাজিয়েছেন। বুঝতে চেষ্টা করেছেন প্রেতচক্রের অন্তর্লীন সত্যকে। সেই সঙ্গে ছুঁতে চেয়েছেন নিজের সারা জীবনের বিচ্ছেদব্যথাকেও। প্রেতচক্র সত্যি কি না, সে প্রসঙ্গ এখানে অনাবশ্যক। কিন্তু এর পিছনে মৃত্যুকে বুঝতে চাওয়া এক জিনিয়াসের আকুতিও যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে আরও গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করার সত্য়িই প্রয়োজন রয়েছে। যা এক মহাজীবনের আরও নতুন কোনও দিককে তুলে ধরতে পারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.