বিশ্বদীপ দে: ‘কোমরিয়া করে লপালপ, কি ললিপপ লাগিলু’ কিংবা ‘রাজা রাজা রাজা করেজা মে সামাজা’। কেবল এইটুকু বললেই কী মনে পড়ে? ভয়ংকর জগঝম্প বাজনা আর শরীরী বিভঙ্গের হিল্লোল। হ্য়াঁ, ভোজপুরী গানের (Bhojpuri songs) এমন অসংখ্য নিদর্শনের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। কোনও বনভোজন কিংবা পুজোর ভাসান অথবা যে কোনও হুল্লোড়ের অনুষ্ঠানে ইদানীং এই ধরনের গানের আধিক্য গোটা দেশজুড়েই। পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও পশ্চিম বিহারের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ কথা বলেন এই ভাষায়। এছাড়াও ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকী নেপালের কিছু অংশেও এই ভাষার প্রচলন রয়েছে। যাঁদের একটা বড় অংশই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের নানা প্রান্তে। এমনকী বিদেশেও। কিন্তু ভোজপুরী বললে এসব নয়, প্রথমেই মনে পড়ে যায় এমন এক ধরনের গান, যাকে ‘অশ্লীল’ বলেই দেগে দিতে চায় সমাজের এক বিরাট অংশ। জানেন কি, স্রেফ এই অপবাদ ও সমালোচনার ছোবলে অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে ভোজপুরী ভাষারই (Bhojpuri)? চোখের সামনে একটু একটু করে মারা যাচ্ছে ভাষাটি। এমনটাই মত কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের।
সংস্কৃত নাকি মৈথিলী- কোন ভাষা থেকে জন্ম ভোজপুরী ভাষার? এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। যথেষ্ট প্রাচীন এই ভাষা। কিন্তু মানুষ বা অন্য জীবের মতো ভাষাও মরে যায়। বহু বিশেষজ্ঞেরই আশঙ্কা আগামী একশো বছরে নাকি নব্বই শতাংশ ভাষা মারা যাবে! হয়তো এমন দাবিতে অতিশয়োক্তি থাকতে পারে। কিন্তু শতাংশের হিসেবটা যদি কমও হয়, তাহলেও মানতেই হবে পরিস্থিতি যথেষ্ট বিপজ্জনক। বাংলা ভাষার ভবিষ্য়ৎও যে খুব সুরক্ষিত নয়, তাও বলাই বাহুল্য। তবে এখানে আমরা ভোজপুরী ভাষা প্রসঙ্গেই থাকব। শোনা যাচ্ছে, পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে ভোজপুরীর একটা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে ওই ধরনের গানের সূত্রে। ফলে শিক্ষিত ভোজপুরী ভাষাভাষী মানুষরা আর সেই ভাষায় কথা বলছেন না। হিন্দি বা অন্য কোনও ভাষায় কথা বলা শুরু করছেন। আশঙ্কা, এমনটা চলতে থাকলে ভোজপুরী ভাষা মূলত অশিক্ষিত ও কর্মহীন মানুষের মুখের ভাষা হয়েই থেকে যাবে।
এমন নয়, শিক্ষিতরা ভোজপুরী গান শোনেন না বা কিংবা উপভোগ করেন না। গানের ‘বিট’ তাঁদেরও মজা দেয়। পার্টিতে কোমরও দুলে ওঠে। গানের ‘রসাল’ লিরিক্স নিয়ে চর্চা করে বন্ধুমহলে। কিন্তু বিষয়টা ওখানেই থেমে যায়। ভোজপুরী ভাষার আর কোনও অস্তিত্ব তাঁদের জীবনচর্চায় নেই। ফলত ক্রমশই ওই বিশেষ ধরনের গানের চারপাশেই যেন বাঁধা পড়ে যাচ্ছে ভোজপুরী ভাষা। বিপন্ন হচ্ছে তার অস্তিত্ব।
কিন্তু কেন এত জনপ্রিয় ভোজপুরী গান? এমন তো নয়, তথাকথিত ‘অশ্লীল’ গান কেবল ভোজপুরী ভাষাতেই তৈরি হচ্ছে। বলিউডে ‘চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়’, ‘সরখাইলে খাটিয়া’ কিংবা ‘অঙ্গনা মে বাবা’র মতো গানের অভাব নেই। টালিগঞ্জেও ‘যতই ঘুড়ি ওড়াও রাতে’, ‘লুচি লুচি ফুলকো লুচি’র মতো গান অনেক পাওয়া যাবে। এমন নিদর্শন দেশের সব ভাষার গানের ক্ষেত্রেই পাওয়া যাবে। এই ধরনের গানগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগটা কমন। সব গানেই নারীকে ‘যৌন বস্তু’ হিসেবে দেখানো হয়। নরনারীর প্রেমকে কেন্দ্র করে ইঙ্গিতবাহী শব্দ ব্যবহার করে শরীরী মিলন কিংবা নারী, পুরুষের গোপনাঙ্গের বর্ণনাও আকছার মেলে। ভোজপুরী গানে মূলত এই একই ধাঁচকে লাগাতার অনুসরণ করে যাওয়া হচ্ছে।
তার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ করলে দেখা যাবে ‘কাটোরা’ (বাটি), ‘ঝাড়ু’ (ঝ্যাঁটা), ‘ললিপপ’, ‘তালা’র মতো সহজ ও সারাক্ষণ ব্যবহৃত অত্যন্ত চেনা শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে গানের লিরিক্সে। এগুলি সবই নারীর (এমনকী পুরুষেরও) গোপনাঙ্গের ইঙ্গিতবাহী। গানের বাক্যগুলিতে যে রূপক বা উপমা ব্যবহার করা হয় সেগুলোও সহজবোধ্য। ফলে একবার শুনলেই পুরোটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তাছাড়া গায়কী ভঙ্গিতেও কার্যতই কামার্ত একটা স্বর ব্যবহার করা হয়। সব মিলিয়ে সুরের চটক ও কথার গমকের দুরন্ত রসায়ন খুব দ্রুত শ্রোতাকে বশ করে ফেলে।
গানের পরিবেশন এমনই, আপনি মনে মনে কখনওই ভাবতে পারবেন না লাদাখের হিমেল পরিবেশ কিংবা কোনও ঝাঁ চকচকে শহুরে আবহে এই গানের দৃশ্যায়ন সম্ভব। ভিডিওগুলিতে চোখ রাখলেই ধরা পড়বে কোনও খেত কিংবা গ্রামীণ পরিবেশেই সেগুলি শুট করা হয়েছে। তবে ভোজপুরী গান কিন্তু মোটামুটি একটা যৌনতার ফ্রেমের মধ্যেই সবটা ধরে। সুড়সুড়ি দেওয়াই সেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য। গানের কথার অশ্লীলতার সঙ্গে ‘বিট’ মিশে একটা মাদকতা তৈরি করে। আর সেইটুকুই উদ্দেশ্য।
মূলত একটি স্থানিক ভাষা হয়েও ভোজপুরীর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পিছনে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান কম নয়। আর এই ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ভোজপুরী গানগুলিও। ফলে সামগ্রিক ভাবেই ‘ভোজপুরী সংস্কৃতি’ বললে এই চটক আর যৌন ইশারার কথাই বোঝে সকলে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়াচ্ছে, গানগুলির জনপ্রিয়তাতেই ভোজপুরী ভাষা বিপণ্ণ হয়ে পড়ছে। তেমনটাই দাবি ওয়াকিবহাল মহলের।
পুরাণ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস কিংবা ব্রিটিশরাজ অথবা নকশাল আন্দোলন- ভোজপুরী অধ্যুষিত ভূখণ্ডের ইতিহাস নানা অধ্যায়ের সাক্ষী। কিন্তু সময়ের নিয়মই হল বিস্মৃতি। চর্চার অভাব সেই গতিকেই ত্বরান্বিত করে। ফলে সমস্ত অতীত মুছে ভোজপুরী ভাষা এখন ললিপপের মোড়কে বাঁধা পড়ে গিয়েছে। আর তাই বেজে উঠছে তার মৃত্যুঘণ্টা। কেবলই নির্দিষ্ট একশ্রেণির মানুষ ছাড়া বাকিরা এই ভাষাকে কথ্যভাষা হিসেবে আর ব্যবহার করছেন না। তাঁদের উত্তরাধিকারীরাও যে ভাষাটাকে ব্যবহার করবে না সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথার’ কুসুমের মতোই ‘শরীর শরীর’-এর এই ফাঁদ থেকে মুক্তি না পেলে ভোজপুরী ভাষার ভবিষ্যৎ এমনই এক ব্ল্যাক হোলের ভিতরে সেঁধিয়ে যাবে- এই আশঙ্কা তাই ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে দিন দিন।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.