বিশ্বদীপ দে: সকাল বুঝিয়ে দেয় দিনটা কেমন যাবে। এমনই এক ইংরেজি প্রবাদের কথা সকলেরই জানা। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মাইকেল মধুসূদন দত্তর মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্বের দিকে তাকালে বোঝা যায়, প্রবাদ সব সময় মোটেই সত্যি হয় না। একদা যিনি বন্ধু রাজনারায়ণকে লেখা চিঠিতে বিদ্যাসাগরকে ব্যঙ্গ করেছিলেন, তিনিই পরে লিখেছিলেন ‘বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।/ করুণার সিন্ধু তুমি, সেই জানে মনে,/ দীন যে, দীনের বন্ধু !– উজ্জ্বল জগতে’… কেমন করে শুরুর তিক্ততার দিন পেরিয়ে তাঁরা বন্ধু হয়ে উঠলেন, কীভাবেই বা বিদেশে কপর্দকহীন মাইকেলের (Michael Madhusudan Dutt) পাশে দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar), তা এক আশ্চর্য ইতিহাস।
বঙ্গ সংস্কৃতির দুই কিংবদন্তির মধ্যেকার সম্পর্কের সেই ‘কাহিনি’র একেবারে শুরুতে রয়েছে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। সে এক আশ্চর্য সময়। বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারের পথে বাংলার জনজীবনকে ‘নতুন আলো’য় ভরিয়ে তুলছেন। অন্যদিকে সাহিত্যে বঙ্কিম-মাইকেলরাও নির্মাণ করছেন আলোকিত এক সরণি। ১৮৬০ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয় তিলোত্তমাসম্ভব। সে কাব্যের বিরূপ সমালোচনা করেন বিদ্যাসাগর। সেই সমালোচনায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হলেন মাইকেল। ধরেই নিলেন সমস্ত পণ্ডিতরা বোধহয় এমনই অবজ্ঞাভরে কাব্যবিচার করতে বসেন। নিজের অমিত্রাক্ষর ছন্দ নিয়ে তখন থেকেই আত্মবিশ্বাসী মধুকবি। তাই বিদ্যাসাগরের সমালোচনা তিনি মোটেই ভালো ভাবে নিলেন না। রাজনারায়ণকে মাইকেল লিখলেন একটি চিঠি। ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠির মধ্যেই রয়ে গিয়েছে তাঁর উষ্মার প্রকাশ।
কিন্তু অচিরেই মাইকেলের তিলোত্তমাসম্ভবে ‘গ্রেট মেরিট’ খুঁজে পান বিদ্যাসাগর। তারও সাক্ষী মাইকেলের লেখা আর একটি চিঠি। প্রায় মাস তিনেক চলেছিল এই দ্বন্দ্ব। বিদ্যাসাগর, যিনি শুরুতে বলতেন, ‘তিলোত্তমা বলে ওহে শুন দেবরাজ,/তোমার সঙ্গেতে আমি কোথায় যাইব?’ তিনি অচিরেই ভুল বুঝলেন। মাইকেলের অবিশ্বাস্য প্রতিভাকে চিনতে দেরি হয়নি বাংলার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষীর। আর সেবছরই মধুসূদন জানান, সমাজ সংস্কারক বিদ্যাসাগরের মূর্তি গড়াতে নিজের বেতনের অর্ধেক অক্লেশে দিয়ে দিতে প্রস্তুত তিনি। যা বুঝিয়ে দেয়, তিক্ততা দূরে সরিয়ে অল্প সময়েই বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা।
১৮৬২ সালের ৯ জুন। ব্যারিস্টারি পড়তে ইউরোপ রওনা হলেন মাইকেল। এদিকে সেবছরই প্রকাশিত ভারতীয় পুরাণের এগারো জন নারীর প্রেমিককে নিয়ে লেখা ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য উৎসর্গ করলেন ‘বঙ্গকূলচূড়’ বিদ্যাসাগরকে। কিন্তু বিলেতের দিনগুলি অচিরেই অসহ্য হয়ে উঠল মাইকেলের কাছে। কেননা দেশ থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেল। জমি সংক্রান্ত জটিলতায় কার্যতই কপর্দকশূন্য হয়ে পড়ে মাইকেল টাকা চেয়ে পাঠালেন। কিন্তু পাওনা টাকার তদ্বির করেও লাভ হল না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল, দেনার দায়ে গলা পর্যন্ত ডুবে গেল। যে কোনও সময়ে জেলও যেতে হতে পারে, পরিস্থিতি এমনই। এহেন অবস্থায় বন্ধু বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখলেন। ততদিনে মাইকেল লন্ডন থেকে প্যারিস হয়ে ভার্সাইয়ে চলে এসেছেন। সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। অবস্থা যখন একেবারে হাতের বাইরে, ১৮৬৪ সালের ২ জুন বিদ্যাসাগরের কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখলেন মাইকেল। অর্থাৎ বিদেশে আসার পরে ততদিনে কেটেছে দুবছর। সেই চিঠিতে ছিল কবির কাতর আর্তি, ‘তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে এই যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।’ সেই চিঠি পেয়ে মর্মাহত হয়ে পড়েন বিদ্যাসাগর। পরের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পেলেন আরও দুই চিঠি। এর পরই বিদ্যাসাগর দেড় হাজার টাকা পাঠান মাইকেলকে। সেই সময় এই অঙ্কের টাকার পরিমাণ ছিল বিপুল। এর পর থেকে জারি ছিল চিঠি ও বিদ্যাসাগরের টাকা পাঠানো। আর সেই টাকার পরিমাণ কখনওই কম ছিল না। যা জোগাড় করতে বিদ্যাসাগরকেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। প্রয়োজনে নিজে ঋণ করেও টাকা পাঠাতেন।
এরই মধ্যে ১৮৬৪ সালে ফ্রান্সে এক বইয়ের দোকানে বিদ্যাসাগরের কয়েকটি বই দেখতে পেলেন মাইকেল। স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর লেখা চিঠিতে ধরা পড়েছে গর্বিত বন্ধুর উচ্ছ্বাস, ‘আমি দোকানদারকে বলেছি যে, এই লেখক আমার পরম বন্ধু।’ এর দুবছর পরে অন্য এক চিঠিতে মাইকেল লেখেন, ‘এখানকার ‘স্যাটার্ডে রিভিউ’-এর আলোচনায় তোমাকে খুবই গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়েছে।’ এই সব চিঠি বুঝিয়ে দেয়, কীভাবে বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ডের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল। পাশাপাশি এও বোঝা যায়, মাইকেলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গভীরতা কতটা ছিল।
১৮৬৭ সালে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরলেন মাইকেল। কিন্তু অভাবও ফিরল তাঁর পিছু পিছু। স্ত্রী-সন্তানকে টাকা পাঠাতে হত। নিজেও বন্ধুদের সঙ্গে মিলে প্রতিদিনই মদ্যপানে ডুবে থাকতেন। এহেন বন্ধুকে অর্থসাহায্য করে গিয়েছেন বিদ্যাসাগর। সব সময় থেকেছেন পাশেই। সেজন্য তাঁকেও নাকি কটূক্তি সইতে হত। তবু চিড় ধরেনি সম্পর্কে। এও জানা যায়, শেষপর্যন্ত নিজের সম্পত্তি বিক্রি করেও বিদ্যাসাগরের ঋণ শোধ করেছিলেন মধুকবি। এর কয়েক বছরই প্রয়াণ ঘটল তাঁর। আজীবন এক আশ্চর্য জীবন কাটিয়েছেন তিনি। দারিদ্র বার বার ছোবল মেরেছে, নিন্দামন্দ সইতে হয়েছে। কিন্তু তিনি থেকেছেন তাঁর মতোই। সেই অর্থে দেখলে সামাজিক জীবনে ব্যর্থই সদ্য দ্বিশতবর্ষ পেরনো মানুষটি। কিন্তু ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তাঁকে বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন এক আসন দিয়েছে। এহেন অবিশ্বাস্য প্রতিভাটিতে চিনতে ভুল করেননি ঈশ্বরচন্দ্র। সারা জীবন পাশে থেকেছেন বন্ধুর। আর মধুসূদনও বুঝতেন তাঁর পাশে বিদ্যাসাগরই একমাত্র রয়েছে। লিখেছিলে, ‘প্রিয় বিদ্যাসাগর, আপনি ছাড়া আমার কোনও বান্ধব নেই।’ তাঁদের ব্যক্তিগত কীর্তির উজ্জ্বলতার সমান্তরালে রয়ে গিয়েছে এক অসামান্য বন্ধুত্বের ইতিহাসও। যাকে আজকের স্বার্থান্বেষী এই দিনকালে ‘আখ্যান’ বলেই মনে হতে থাকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.