অলঙ্করণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
বিশ্বদীপ দে: নেহাতই ক্লিশে একটা বাক্য দিয়ে শুরু করা যাক। ‘যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে’। আসলে যতই বহু ব্যবহৃত হোক, বারংবার এই বাক্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সত্যকে উপলব্ধি করতে হয় বলেই এর ধার ও ভার আজও কমেনি। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রের আয়ুষ্মান কার্ডে নাকি কিছু পরিবর্তন করা হবে। যার মধ্যে অন্যতম বিনামূল্যে লিঙ্গ পরিবর্তনের সুবিধা। রূপান্তরকামীরা তাঁদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছেন, এই খবর স্বস্তিদায়ক। আর এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে মহাভারতের (Mahabharat) কথা। মনে পড়ে শিখণ্ডীকে। কত বছর আগে মহাকাব্যের পাতায় ঠাঁই পেয়েছিল লিঙ্গ পরিবর্তনের মতো বিষয়! যা আধুনিক বিশ্বেও সমান প্রাসঙ্গিক। ভাবলে অবাক লাগে। মহাভারতের কবি অতদিন আগে কী করে ভাবলেন এমন এক বিষয়ে।
মহাভারতের অম্বা পরের জন্মে শিখণ্ডী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জন্মেছিলেন শিখণ্ডিণী হয়ে। নারী থেকে পুরুষ হওয়ার পথ তিনি পেরতে পেরেছিলেন স্থূণাকর্ণের হাত ধরে। তিনি মানুষ নন, যক্ষ। তাঁর সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময় করেছিলেন অম্বা। মহাভারতের বিরাট আখ্যানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অজস্র উপাখ্যান আসলে কেবল যে মূল কাহিনিধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তা নয়। সেগুলিও একেকটি স্বতন্ত্র গল্প। আর সেই গল্পের মধ্যে ধরা রয়েছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা-আবেগের চিরকালীন আবেদন। মহাভারতের উদ্যোগপর্বের শিখণ্ডী-স্থূণাকর্ণর উপাখ্যানও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সেই উপাখ্যানে ঢোকার আগে অম্বার কথা বলতেই হয়।
কাশীরাজের বড় মেয়ে অম্বা চাননি বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করতে। বাবার অজ্ঞাতসারেই তিনি মন দিয়েছিলেন শাল্বরাজকে। তাই যখন ক্ষত্রিয় রীতি মেনে স্বয়ম্বর সভা থেকে তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা, অম্বালিকাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভীষ্ম, অম্বা রাজি হননি যেতে। গায়ের জোরে তাঁকে নিয়ে যেতেই পারতেন ভীষ্ম। কিন্তু তা না করে তিনি শাল্বরাজের কাছেই পাঠিয়ে দেন অম্বাকে। কিন্তু শাল্বরাজ আর গ্রহণ করেননি অম্বাকে। এই পরিস্থিতিতে অম্বার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ভীষ্মেরই উপরে। প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলতে থাকা নাতনিকে আশ্বস্ত করেন রাজর্ষি হোত্রবাহন। তাঁরই উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত পরশুরামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় অম্বার। সব শুনে তিনি ভীষ্মকে ডেকে পাঠান কুরুক্ষেত্রের সরস্বতী নদীতীরে। সেখানে প্রবল যুদ্ধ হয় তাঁদের। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই লড়াইয়ে কেউই হারেননি। ফলে অধরাই থেকে যায় অম্বার প্রতিশোধ।
শেষ পর্যন্ত গভীর তপস্যা শুরু করেন অম্বা। তাঁকে বর দেন মহাদেব। জানিয়ে দেন, পরের জন্মে দ্রুপদের কন্যা হয়ে জন্মালেও পরে তিনি পুরুষই হবেন। একই সময়ে তপস্যারত দ্রুপদকেও সন্তানলাভের বর দিয়েছিলেন তিনি। জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর একটি ‘স্ত্রীপুরুষ’ সন্তান হবে। এরপর অম্বা আগুনের কাছে নিজেকে সঁপে মৃত্যুবরণ করেন। জন্ম নেন রূপসী এক কন্যা হয়ে। কিন্তু তাঁকে পুরুষ হিসেবেই বড় করা হতে থাকে। নাম দেওয়া হয় শিখণ্ডী। যদিও আসল নাম ছিল শিখণ্ডিণী। তবু যেহেতু পুরুষ পরিচয়ই সকলে জানত, তাই তিনি বড় হলে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া হয় তাঁর। বিয়ের পরে সব সত্যি ধরা পড়ে যায় রাজকন্যার কাছে। হিরণ্যবর্মার ক্রোধ গিয়ে পড়ে দ্রুপদের উপরে। যুদ্ধ বাঁধার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়।
তাঁর জন্য মা-বাবাকে এমন কষ্ট পেতে হচ্ছে, এই দুঃখে এরপর বনবাসী হন শিখণ্ডিণী।
আর এইখানেই কাহিনিতে প্রবেশ করেন স্থূণাকর্ণ। বনের মধ্যে একটি বাড়িতে থাকতেন কুবেরের অনুচর ওই যক্ষ। দেখা হয় দু’জনের। যক্ষ তাঁকে মনষ্কামনা জানাতে বললে শিখণ্ডিণী তাঁর গতজন্ম ও বর্তমান জন্মের কথা খুলে বলেন। প্রার্থনা করেন, ”আমাকে পুরুষ করে দিন।” এরপরই লিঙ্গ বিনিময় করেন দু’জনে। শিখণ্ডিণী সত্য়িই হয়ে ওঠেন শিখণ্ডী। আর স্থূণাকর্ণ হয়ে যান নারী। কিন্তু সেই সময় বিষয়টা ছিল নিতান্তই সাময়িক। দ্রুপদকে হিরণ্যবর্মার সামনে অস্বস্তি থেকে বাঁচানো পর্যন্তই ছিল তাঁর মেয়াদ। কিন্তু এরপরই কুবেরের প্রবেশে ঘুরে যায় ঘটনাপ্রবাহ।
শ্বশুরবাড়ির কাছে নিজেকে পুরুষ হিসেবে ‘প্রমাণ’ করার পরে ফের স্থূণাকর্ণের কাছে ফিরে এসেছিলেন শিখণ্ডী। কিন্তু তার আগেই সেখানে এসেছিলেন কুবের। তিনি স্থূণাকর্ণের লিঙ্গবদলের কথা জানতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তিনি অভিশাপ দিলেন, স্থূণাকর্ণ আর পুরুষ হতে পারবেন না। ফলে স্ত্রীলক্ষণ নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিতে হয় তাঁকে। তাঁর কাছে সব শুনে শিখণ্ডী ফিরে যান রাজপ্রাসাদে। দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা শুরু করেন। এই দ্রোণই কিন্তু পরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীকে ‘পাপমতি শঠ’ বলে ভর্ৎসনা করেন। শেষ পর্যন্ত শিখণ্ডীকে দেখে ভীষ্মের অস্ত্র নামিয়ে রাখা ও অর্জুনের ছোঁড়া তিরে শরশয্য়া লাভের কথা সকলেরই জানা। এখানে তা অপ্রয়োজনীয়ও।
গ্রিক পুরাণে আফ্রেদিতির সন্তান হারমাফ্রোদিতোস ছিলেন উভলিঙ্গ। তিনি উড়তে পারতেন। যা থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন সেই যুগে এই বিষয়টি বারবার ভাবিয়েছে স্রষ্টাদের। একই ভাবে শিখণ্ডীর আখ্যান ছাড়াও রূপান্তরকামের প্রসঙ্গ মহাভারতে রয়েছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভঙ্গাস্বন নামে এক ধার্মিক রাজার কথা আছে। শিকার করতে গিয়ে সরোবরে স্নান করতে নেমে তিনি হঠাৎই নারী হয়ে যান। পরে পুরুষত্ব ফেরানোর প্রস্তাব কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কেননা তাঁর মতে, সম্ভোগের আনন্দ নারী অবস্থাতেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।
মনে পড়ে বৃহন্নলারূপী অর্জুনকেও। মধ্যম পাণ্ডব নিজেকে বর্ণনা করেছিলেন তৃতীয়া প্রকৃতি হিসেবে। তাঁর যোদ্ধা শরীরে নারীর কোমলতা ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব বুঝতে পেরেই এই ছদ্মবেশেই অজ্ঞাতবাসের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। হাতের বালা ও দীর্ঘ বেণীর আবেদনে অনায়াসে বিশ্বাস অর্জন করেও ফেলেন। তাঁর নাচ ও গানের মাধ্যমে মন জয় করেন রাজা ও অন্তঃপুরের নারীদেরও। এই ভাবে নারী ও পুরুষ চরিত্রগুলির মতোই রূপান্তরকামও মহাকাব্যে জায়গা করে নিয়েছে। এরপর পাকের পর পাক ঘুরে আরও বুড়ো হয়েছে পৃথিবী। রূপান্তরকাম ও রূপান্তরকামী মানুষদের লড়াই একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে। আর সেই সময়ে দাঁড়িয়েই মহাকাব্যের পাতায় লেখা আখ্যান আরও একবার প্রমাণ করে দেয় কেন যুগের পর যুগ পেরিয়ে এই গ্রন্থগুলির কাছে ফিরে যেতে হয় আমাদের।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.