সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: এ পৃথিবী একবারই পায় তাঁকে। স্বয়ং সংগীতের দেবী যদি বসতেন সুরের উপাসনায়, তবে কেমন হত তাঁর কণ্ঠস্বর! ত্রিভুবন তার উত্তর খুঁজলেও, এ ধূলিধূসরিত পৃথিবীর মানুষই জানে, সে কণ্ঠ নিশ্চিতই হত লতা মঙ্গেশকরের। সুরের ঈশ্বরী তিনি, ছদ্মবেশেই যেন এ পৃথিবীকে উপহার দিয়ে গেলেন সংগীতের প্রচুর ভাঁড়ার। জীবনপথে ব্যক্তি মানুষের চলা একদিন অকস্মাৎ থেমে যায় অমোঘ নিয়মে। কিন্তু ফুরোয় না তাঁর সুর আর সংগীতের অনন্ত যাত্রা। কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকরেরও পার্থিব অধ্যায়ে আজ নেমে এল যবনিকা, এবার আগামীর পথে অপার্থিব পথচলা তাঁর সমূহ কীর্তির।
করোনা এসে পৃথিবীকে নিঃস্ব করেছে নানারকম ভাবে। লতা মঙ্গেশকরে চলে যাওয়ায় আরও একটু নিঃস্ব হলাম আমরা। এ আসলে এমন ক্ষতি, কোনও বিকল্পই যা পূরণ করতে পারে না। ১১ জানুয়ারি খবর আসে করোনা আক্রান্ত সুর-সম্রাজ্ঞী। তাঁকে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভরতি করা হয়। বয়সের কথা মাথায় রেখেই আইসিইউ-তে রাখা হয়েছিল তাঁকে। সতর্ক ছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। সুরলোকে পাড়ি দিলেন সুরের ঈশ্বরী।
১৯২৯-এ জন্ম লতা মঙ্গেশকরের। বাবা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছে সংগীতে হাতেখড়ি। ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান। তারপর থেকে সংগীতই তাঁর সঙ্গী। তখন থেকেই শুরু গান গাওয়া। ১৯৪৫-এ চলে এলেন মুম্বই অর্থাৎ তৎকালীন বম্বেতে। এর কিছুদিন পরেই গুলাম হায়দারের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। পরে এক সাক্ষাৎকারে যাঁকে ‘গডফাদার’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন লতা। হায়দার সাব ছোট্ট লতাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত প্রযোজক শশধর মুখার্জির কাছে। তাঁর পছন্দ হয়নি লতার কণ্ঠ। মনে হয়েছিল, মেয়েটির গলা তেমন নয়। বিরক্ত হায়দার সাব সেদিন বলেছিলেন, একদিন এই কণ্ঠের জন্যই প্রযোজকদের লাইন পড়ে যাবে। অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল সে কথা। ১৯৪৮ সালের ছবি মজবুর-এ তিনি লতাকে দিয়ে গাওয়ালেন গান – দিল মেরা তোটা, মুঝে কহিঁ কা না ছোড়া। বাজিমাত হল সেই গানে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লতা মঙ্গেশকরকে। হায়দার সাব শুধু রত্ন চিনেছিলেন তা নয়, চিনেছিলেন কোহিনূর।
পরবর্তী কয়েক দশক জুড়ে ভারতীয় সংগীতকে ক্রমশ নিজের প্রতিভায় বশ করে ফেললেন লতা। শুধু প্রযোজকদের লাইন লেগে যাওয়াতেই তার মূল্যায়ণ হয় না। বহু সংগীতপ্রতিভার জন্ম দিয়েছে এই দেশ, আর তাঁরা সবিস্ময়ে লক্ষ করেছেন লতাকে। এমন কণ্ঠ, এমন রেওয়াজ, এমন দক্ষতা, উৎকর্ষ এবং নিখুঁত উপস্থাপনা- একজন সংগীতশিল্পীর মধ্যে বহুগুণের এহেন অপূর্ব নিখুঁত সমাবেশ হয় কী করে! উত্তর মেলেনি। অথবা উত্তর একটাই, এই প্রতিভা ঐশ্বরিক। সাধারণের দলিল দস্তাবেজে তাঁর ঠিকানা লেখা থাকে না। ভারতীয় সংগীত ক্রমশ তাঁর কণ্ঠ ছুঁয়ে অন্যতর ও ভিন্নতর উচ্চতা লাভ করতে থাকল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী থেকে শুরু করে এ আর রহমান – লতা মঙ্গেশকরের সুরের সফর যেন ভারতীয় সংগীতের এক চলমান ইতিহাস। ভারতরত্ন তিনি, পেয়েছেন দাদাসাহেব ফালকে সম্মানও। আসলে, যে কোনও সম্মানই যেন সম্মানিত হয়েছে তাঁকে স্পর্শ করে। প্রতিভা, বিস্ময় প্রতিভা ইত্যাদি শব্দবন্ধ পেরিয়ে একটি অন্য স্থানাঙ্কে অবস্থান কিন্নরকণ্ঠীর, যেখানে তাঁর বিশেষণ তিনি নিজেই। লতা মঙ্গেশকরের নামের আগে কোনও শব্দ বসিয়ে তাঁকে মহিমান্বিত করা যেন বাহুল্য; তিনি নিজেই ভাস্বর, উজ্জ্বল, নির্বিকল্প এবং নক্ষত্র।
আজ দৈহিক পরিভ্রমণ শেষ হল তাঁর। সাত সুরের আশমানে তবু তিনি চিরকালীন ধ্রুবতারা। সা থেকে সা – যতদিন সংগীত থাকবে, শিক্ষার্থী তানপুরায় আঙুল রেখে খুঁজেবেন সুরের মোকাম, ততদিন এ পৃথিবী বিস্ময়ে খেয়াল করবে, কোমলে-ধৈবতে বেজে উঠছেন একজনই। তিনি সুরের ঈশ্বরী – লতা মঙ্গেশকর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.