চারুবাক: লেখক সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর কলম হাসিমজার মোড়কে অপ্রিয় বাস্তব, সত্য কথনে কখনও দ্বিধা করে না। সাপ্তাহিক ফিচার, ছোট গল্প নয়, এবার আজকের রাজনীতির চেহারা, গতি প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা ‘স্পেয়ার পার্টস’ (Spare Parts) নাটক লিখেছেন তিনি। সেই রাজনীতি শুধু এই রাজ্যের মূক, নির্বাক, স্তব্ধ, প্রতিবাদহীনতার কথাই বলেনি কেন্দ্রের গো-রাজনীতিকেও বেড়ালের সঙ্গে তুলনা করে বেশ একহাত নিয়েছে।এমনকী শেষপর্যন্ত আন্তর্জাতিক বহুজাতিক ব্যবসায়িক সংস্থাগুলোর অঙ্গুলিহেলনেই যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকরা পুতুলের মতো নাচে, সেটা বলতেও কোনো দ্বিধা করেননি।
নাটকটির সবচেয়ে জোরের জায়গা হল দর্শকের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ডাকে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন রাখা। যদিও, নাটকটির বহিরাঙ্গে স্ল্যাপস্টিক কমেডির পোশাক চড়ানো। তবে নাট্যকার ও পরিচালক সীমা মুখোপাধ্যায়ের মূল উদ্দেশ্য জলের মতো পরিষ্কার। দেশের প্রতিটি জায়গায় গণতন্ত্র রক্ষার মুখোশ পরে গণতন্ত্রকে হত্যা করার বীভৎস উল্লাসে মেতেছে রাজনৈতিক নেতারা। দুর্নীতি, পাইয়ে দেবার রাজনীতি, দেশের সম্পদ ব্যবসায়ীদের হাতে বিক্রি করে দেওয়া থেকে প্রায় পুরো দেশটাই এখন বিক্রির কাঁচা মাল যেন। সমাজের প্রতি নাট্যকারের তীব্র কটাক্ষ, সমালোচনা, সাধারণ মানুষের নিস্পৃহতা দেখা গিয়েছে। যা এমন সরাসরিভাবে উপস্থিত করতে সাম্প্রতিক কোনও বাংলা প্রযোজনায় দেখা যায়নি।
নাটকের মূল চরিত্র মধুসূদন বসাক সাইকেলের স্পেয়ার পার্টসের ব্যবসা থেকে নিজের কূট বুদ্ধির বলে মানুষের শরীরের ‘স্পেয়ার পার্টস’-এর ব্যবসা করতে ‘HULCO’ (হিউম্যান লিম্বস) নামের কোম্পানি খুলেছে। সেখানে কিডনি, হার্ট, চোখ, ফুসফুস, কান, লিভারের মতো শরীরের অংশ কিনে শোরুম করেছেন মধুবাবু। তাঁর তরুণী সহকারী তথা সেক্রেটারি অজানা জানাই সব দেখাশুনা করেন। মধুবাবুর বিশ্বাস রাজনৈতিক নেতারা যেমন গুণ্ডা পোষেন, তেমনই ব্যবসায়ীদেরও নেতা পুষতে হয় উভয়ের স্বার্থের কারণে।
পরিচালক নাট্যকার ওই শোরুমে আটকে থাকা মানুষগুলোর মধ্য দিয়েই আজকের সত্যগুলোকে উপস্থিত করেন মঞ্চে। কখনও গান, কখনও নাচ বা আবার কখনও সরাসরি দর্শকের সামনে এসে মঞ্চ থেকে নেমে ঘুরে ঘুরে এই সামগ্রিক দুরবস্থা বিরুদ্ধে অন্তত চিৎকার করে উঠতে বলেন। বলেন, “আমরা না হয় মাধুবাবুর কাছে বিক্রি হয়ে গেছি, আপনারা? আপনারা তো এখনও বিকিয়ে যাননি। পাড়ায় পাড়ায় লেগেছে আগুন হু হু, এখনও কি নির্বাক নীরব নিস্পৃহ হয়ে থাকার সময়?”
‘রঙরূপ’ প্রযোজিত এই ‘স্পেয়ার পার্টস’ পরিষ্কার ভাবেই জানিয়ে দিচ্ছে, সময়ের বদল দরকার। কিন্তু কে বদলাবে? সেই আগুনে প্রশ্নটাই শেষ মুহূর্তে মঞ্চে ঢুকে নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায় নিজেই দর্শকের দিকে ছুঁড়ে দেন। অ্যাকাডেমির মঞ্চে দর্শকদের মধ্যে তখন একটু যেন নড়েচড়ে ওঠার প্রস্তুতির আভাস মেলে। আর এখানেই রঙরূপের এই প্রযোজনার সার্থকতা। সত্যিই বেশ টান টান উপস্থাপনা, নাচ-গান সমবেত অভিনয়ে জমজমাট ‘স্পেয়ার পার্টস’।
নাটকের মুখ্য চরিত্রে প্রবীণ অভিনেতা কমল চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব স্টাইলেই মধুবাবুর চরিত্রটি হাসিমজার জামা পরিয়ে জমিয়ে দিয়েছেন। অজানার চরিত্রের শিল্পীও তাঁর সঙ্গে সমান তালে তাল মিলিয়েছেন। একঝাঁক সফল শিল্পীর তালিকায় রয়েছেন অনন্য শংকর দেবভূতি, অপূর্ব কুমার সাহা, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, আর্য জানা, সুস্মিতা পান, অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়,আরাত্রিকা মুখোপাধ্যায়, পৌলমী তালুকদার, কুণাল সাহা, অনুভব মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা। কলকাতার নাট্যসংস্থা আজকের সময়কে এড়িয়ে থাকছে — এবার আর এই কথাটা বোধহয় বলা যাবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.