সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ”আমি তো এক শখের নিছক শব্দব্যবসায়ী/আনন্দের ক্লান্তি আনে আমার চোখে ঘুম”… ক্লান্তিই বুঝি ঘুম এনে দিল তাঁর দু’চোখে। চিরঘুমে তলিয়ে গেলেন পঞ্চাশের দশকের বাঙালির কাব্যপ্রেম উসকে দেওয়া কবি (Poet) অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (Alokeranjan Dasgupta)। বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন ৮৭ বছরে জার্মানি প্রবাসী কবি। স্থানীয় সময়ে মঙ্গলবার রাত ৯টা নাগাদ প্রয়াত হন। দূরত্বের ব্যবধান ঘুচে ভারতে গভীর রাতেই পৌঁছে যায় দুঃসংবাদ। হেমন্তের রাত যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে।
১৯৩৩ সালের ৬ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ করে সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পা রাখেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। পিএইচডি করেন ভারতীয় কবিতার শব্দমালা নিয়ে। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে এক যুগেরও বেশি সময়ে পড়িয়েছেন। সেসময়ই জার্মান (Germany) সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ থেকে অনুবাদের কাজ হাত দেন। বহু জার্মান কবিতা কাব্যগুণ বাঙালি আহরণ করেছেন তাঁর লেখনীতে। বাংলার সাহিত্য সম্ভারকেও তিনি অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন রাইন নদীর দেশে। এরপর হামবোল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ নিয়ে পড়াতে যান জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া সে দেশের অত্যন্ত নামী প্রতিষ্ঠান ডয়েশ-ইনডিশ-গ্যাসেলশ্যাফট, যা মূলত ভারত-জার্মানির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করে, সেখানকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বাংলা-জার্মান সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর মতো বিরাট কর্মকাণ্ডের জন্য সে দেশের সরকারের তাঁকে ‘গ্যেটে’ পুরস্কারে সম্মানিত করে। জার্মানিতেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। তবে কলকাতার সঙ্গে সংযোগ ছিল নিবিড়। এখানকার সমসাময়িক সাহিত্য নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। তরুণ প্রতিভাদের চিনে নিত তাঁর জহুরির চোখ।
”চৌরঙ্গীর ফুটপাথে/আমার শতাব্দীর কামধেনু/ঢেলে দিচ্ছে কালো দুধ সীসা-রঙা/যে খাবে তার মৃত্যু হবে/ যে খাবে না, তার মূর্খতা ভালোবাসি না” – এভাবেই বোধহয় মৃত্যু আর মৃত্যুহীনতার স্বপ্নে ধাবমান মূর্খতাকে কবিতার ভাষায় ধরেছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। প্রকৃতির রূপ থেকে সমসময়ের সংকট কিংবা পরিস্থিতি, অনবদ্য কাব্যিক সুরে এঁকে দিয়েছেন তিনি। একে একে লিখে ফেলেছিলেন ২০ টি কাব্যগ্রন্থ। সাহিত্য জগতে বিশেষ অবদানের জন্য একাধিক পুরস্কারও লাভ করেছেন কবি। ১৯৯২ সালে ‘মরমী করাত’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এই কাব্যগ্রন্থই পরবর্তীতে তাঁকে প্রবাসী ভারতীয়ের সম্মান এনে দেয়। এছাড়া পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার।
কবেই তো লিখে গিয়েছিলেন, ”এখন যুদ্ধ না শান্তি স্পষ্ট করে বুঝতেই পারি না……/যুদ্ধ ঠিক শেষ হয়নি, অথবা এখন শান্তি শেষ…”। আজ এক যুদ্ধ-শান্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্ব থেকে বিদায় নিলেন কবি অলোকরঞ্জন। ”উত্তর অতলান্তিকে বৃষ্টি হলে/তোমার এখানে কেন রৌদ্র হবে?” রৌদ্র হয়নি আজ, এখানে। উত্তর অতলান্তিকের বৃষ্টি ঝরে পড়েছে বাংলার মাটিতে, অশ্রুকণা হয়ে। বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে খসে পড়েছে যে একটি নক্ষত্র, বড় অসময়ে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.