বিশ্বদীপ দে: ‘… গুরুদেবকে সবাই মিলে নিচে নিয়ে গেল। দোতলার পাথরের ঘরের পশ্চিম বারান্দা হতে দেখলাম- জনসমুদ্রের উপর দিয়ে যেন একখানি ফুলের নৌকা নিমেষে দৃষ্টির বাইরে ভেসে চলে গেল।’ বইয়ের নাম ‘গুরুদেব’। লেখক রানি চন্দ। তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থের একেবারে শেষে এভাবেই আমরা দেখতে পাই বাইশে শ্রাবণের এমন এক বর্ণনা। সেই অনুচ্ছেদের ঠিক আগের অনুচ্ছেদের শেষেই তিনি লিখেছেন, ‘গুরুদেব যে রাজার রাজা, শেষ যাওয়াও তিনি সেইভাবেই তো যাবেন।’ কিন্তু সত্য়িই কি বিদায়বেলায় প্রার্থিত আড়ম্বরহীন মুহূর্ত পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)? সহজ উত্তর, পাননি। বরং ঘটেছিল উলটোটাই। যা প্রতিটি বাঙালির কাছেই এক চরম লজ্জা। নতুন এক বাইশে শ্রাবণের (Rabindranath Tagore death anniversary) সামনে দাঁড়িয়ে সেই অস্বস্তিকর ইতিহাসকেই আরও একবার ফিরে দেখা।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরে তাঁকে যেন শান্তিনিকেতনে (Santiniketan) নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৩০ সালের ২৫ অক্টোবর ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে সেবিষয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন- ‘আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায় হয়– শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্ম্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।’ সেদিন কি ঘুণাক্ষরেও রবীন্দ্রনাথ ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর সেই ইচ্ছাকে ন্যূনতম সম্মানটুকুও দেবে না বাঙালি! ভিড়ের বাঙালি। আম বাঙালি। বরং ‘মেমেন্টো’ সংগ্রহের অশ্লীল নেশায় কবির চুল-দাড়ি ও নখ শরীর থেকে উপড়ে নিয়ে যাবে। আপনজনদের কাছ থেকে কার্যত ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কবির দেহকে। ভাবতে বসলে সত্য়িই বিস্মিত হতে হয়। কী করে সম্ভব হয়েছিল এমন হৃদয়হীন বর্বরতা?
ঠিক কী হয়েছিল সেদিন? নির্মলকুমারী মহলানবিশের ‘বাইশে শ্রাবণ’ বইটিতে রয়েছে তার জীবন্ত বর্ণনা- ‘জোড়াসাঁকোর আঙিনাতে নেবে দেখি জনসমুদ্র পার হয়ে উপরে যাওয়া অসম্ভব। ও-বাড়ির অন্যান্য অংশও চিনি বলে অন্য রাস্তায় সহজেই উপরে উঠতে পারলাম।… ঘরে লোকে লোকারণ্য।… যখন স্নান করানো হচ্ছে, নিচের জনতার মধ্যে একদল উপরে এসে বাইরে থেকে টান মেরে দরজার ছিটকিনি খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। কী দারুণ অপমান কবির চৈতন্যহারা এই দেহটার!… ভিতর থেকে দরজায় ছিটকিনি সত্ত্বেও হাত দিয়ে ঠেলে ধরে রাখা হয়েছে। তবু বাইরে থেকে প্রাণপণ ঝাঁকানি আর উন্মত্ত চিৎকার- দরজা খুলে দিন, আমরা দেখব।’
দৃশ্যটুকু কল্পনা করলেই শিউরে উঠতে হয়। আর এই দৃশ্যের মধ্যেই ইঙ্গিত ছিল, কী হতে চলেছে। নির্মলকুমারী লিখছেন, ‘বেলা তিনটের সময় একদল অচেনা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষে আমাদের সামনে থেকে সেই বরবেশে সজ্জিত দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল। যেখানে বসে ছিলাম সেইখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। শুধু কানে আসতে লাগল – ‘জয় বিশ্বকবির জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’।’
অথচ ঠিক এমনটা যাতে কোনও ভাবেই না হয়, সেটাই ছিল কবিগুরুর আর্তি। নির্মলকুমারী মহলানবীশকে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, ‘জয় বিশ্বকবির জয়’, ‘জয় রবীন্দ্রনাথের জয়’, ‘বন্দেমাতরম’ – এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে। আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়…।’ কিন্তু হায়…
ভাইঝি ইন্দিরা দেবী থেকে শুরু করে কিংবদন্তি বিজ্ঞানী প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের স্ত্রী নির্মলকুমারী, সকলের কাছেই বারবার যে আকুতি করেছিলেন কবি, শেষ পর্যন্ত তা রাখা যায়নি। তার চেয়েও মর্মান্তিক, লাঞ্ছনার সেখানেই শেষ নয়। কবির শেষযাত্রায় কাতারে কাতারে মানুষ নেমে এসেছিলেন রাজপথে। নিমতলা ঘাটে যাওয়ার পথ ভিড়ে ভিড়াক্কার। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ পৌঁছতেই পারলেন না কবির কাছে। ফলে মুখাগ্নিই করে উঠতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত মুখাগ্নি করেন ঠাকুর বংশের আরেক সদস্য সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পর্কে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাতি। চারপাশে প্রবল ভিড়।
কিন্তু শেষযাত্রায় রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে থেকেছিলেন যাঁরা,তাঁরা কারা? শোনা যায়, প্রণামের অছিলায় পায়ের নখ তুলে নেওয়া হয়েছিল। ভিড়ের সুযোগে চুল বা দাড়িও ছিঁড়ে নিয়েছিলেন অনেকে। উদ্দেশ্য, নিজের কাছে রেখে দেবেন স্মারক! ভাবা যায়! অথচ রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে থাকার কথা তো ছিল তাঁর আপনজনদের। শেষ সময়ে যাঁরা আগলে থেকেছেন তাঁকে, তাঁদের হাত থেকেই ছিনিয়ে যাওয়া হল কবিকে। এবিষয়ে নির্মলকুমারী মহলানবীশের লেখায় ঝরে পড়তে দেখি চূড়ান্ত আফসোস। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র প্রদ্যোতকুমার সেনকে তিনি জানিয়েছিলেন, কবির শেষ ইচ্ছা মেনে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হোক। কিন্তু প্রদ্যোত খানিক পরে তাঁকে জানিয়ে দেন, ”না, রানিদি হল না। সবাই বলছেন শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এখানেই সব আয়োজন হয়ে গিয়েছে।” যা শুনে নির্মলকুমারীর মনে হয়েছিল, ‘এই ‘সবাই’ যে কারা তা আর প্রশ্ন করলাম না।’
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘হিরোসিমা, মাই লাভ’ উপন্যাসে লিখেছিলেন ‘জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করে না।’ নিঃসন্দেহে এ এক অমোঘ বচন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে তাঁর শরীর হাইজ্যাক করেছিল যারা, অসম্মান তো তারা নিজেদেরই করেছিল। তবু, এও তো সত্যি যে, মৃতের শেষ ইচ্ছা সব সময়ই পূর্ণ করতে চান তাঁর আপনজনেরা। কবির আক্ষেপ ছিল, ”কলকাতার উন্মত্ত কোলাহল, জয়ধ্বনির কথা মনে করলে আমার মরতে ইচ্ছে করে না।” তিনি চেয়েছিলেন ‘শান্তম’ মন্ত্রই যেন সার্থক হয়ে ওঠে বিদায়বেলায়। কিন্তু বাঙালি সেই অবসরটুকু দেয়নি।
তবে ওই উন্মত্ত ভিড়কেই একমাত্র ছবি ভেবে বসলে ঠিক হবে না। বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে সেই দিন বাঙালি জাতি হিসেবে কতটা নিঃস্ব, কতটা শূন্যহৃদয় হয়ে পড়েছিল তার বর্ণনা। এমনকী, ওই ভিড়েরও একটা বড় অংশ সত্য়িই শোকে হতবাক হয়ে শেষযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। যে শোকের অভিঘাত স্থায়ী হয়েছিল আরও দীর্ঘ দীর্ঘ সময়। বলতে গেলে সেই দিনটি থেকেই বাইশে শ্রাবণ তারিখটি শোকের সঙ্গেই সমার্থক হয়ে গিয়েছে। যে তারিখ ভুলে যাওয়া বাঙালির কাছে অপরাধতুল্য। জয় গোস্বামী তাঁর কবিতায় প্রশ্ন করেছেন, ‘তোমার কি মেঘ দেখে মনেও পড়ল না আজ ছিল বাইশে শ্রাবণ?’ সত্য়িই তো। বর্ষার গাঢ় মেঘের ভিতরেই চিরকালীন শিলালিপি হয়ে রয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়ার দিনটি। তবু সেই শোকের সমান্তরালে এক লজ্জার ইতিহাসও রয়েছে। তাকেও ভুলতে পারা কঠিন। হয়তো অসম্ভব। এবং জরুরিও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.