অভিরূপ দাস: কোন হিমবাহ থেকে শুরু হয় গল্পের নদী? কলমের আঁচড়ে কুলকুল যা বইতে শুরু করে? শব্দের আখরে স্নান করে অগনিত পাঠক পাঠিকা। লক্ষ্মীবারে বাংলা আকাদেমি সভাঘরে গল্প শুরুর গল্প শোনালেন একঝাঁক সাহিত্যিক। জয়ন্ত দে, কুণাল ঘোষ, গৌর বৈরাগী, বিশ্বদীপ দে-রা বললেন, দুই মলাটের আখ্যান কাল্পনিক নয়। তাতে লুকিয়ে থাকে লেখকের অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন জীবন থেকে অধিত জ্ঞান। কোনও বিশেষ সময় থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ সে কাহিনী লেখক বন্দি করেন দু’মলাটে। বাংলা আকাদেমির (Bangla Academy) সাহিত্য বাসরে এদিন সঞ্চালক হিসেবে হাজির ছিলেন ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক শেখর বসু। আলোচনা শুরুর সুতো বুনে দিলেন তিনিই।
আখ্যান তো আদতে এক মহীরূহ। পাঠককে যে ছায়া দেয়। ছোট্ট একটা শব্দের বীজ থেকেই ডালপালা মেলে গল্পের প্লট। ‘‘গল্প লেখকের মুখ থেকে গল্পের জন্মকথা শোনার এই আলোচনা অভিনব। অনেক তুচ্ছ বিষয় এমনকি আড্ডা থেকেও জন্ম নেয় একটা ক্লাসিক (Classic)। প্রাথমিকভাবে তার কাঠামো তৈরি হয়। লেখা যতে এগোতে থাকে ধীরে ধীরে তা মূর্তির রূপ নেয়।’’ বললেন শেখর বসু। জানালেন কীভাবে গল্পের শেষটুকু বদলে যায়।
আলোচনা শুরুর প্রথম বক্তা লেখক জয়ন্ত দে, প্রথম জীবনে যিনি কবিতা লিখতেন। উনিশো বিরানব্বই সালে কলকাতার দাঙ্গা। খবরের কাগজের অফিসে প্রুপ রিডার ছিলেন জয়ন্ত দে। নিজের কৌতুহলে রিপোর্টারের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন দাঙ্গা বিধ্বস্ত কলকাতার অলি গলিতে। ধর্মীয় কাজিয়ার হিংসা আঁচড় কেটেছিল বুকে। তা থেকেই কলমে আসে ‘পেন্ডুলাম।’ প্রথম গল্প। সেই শুরু। সেই কাহিনীই সাত ভাষায় ছাপা হয় একদিন।
সাহিত্য সৃষ্টির গল্প বলতে এরপর মঞ্চে বিশিষ্ট সাংবাদিক। গল্পের জন্মকথার সলতে উসকে দিলেন কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। সহজ সরল সাবলীল ভাষায় বললেন, ‘‘খবর করতে গিয়ে নানান জায়গায় যেতে হয়েছে। পড়াশোনা করতে হয়েছে অগাধ। কোনও একটা চরিত্র গেঁথে গিয়েছে মনের মধ্যে।’’ এরপর সেই চরিত্রটাকেই সাজানো। হরেক চিন্তা। যদি উনি এমনটা না হয়ে অন্যরকম হতেন? যদি ঘটনার স্থানকালপাত্র বদলে যেতো? গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকে গল্প। মঞ্চে যখন কুণাল ঘোষ দর্শকাসনে তখন এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ গল্পকার প্রচেত গুপ্ত। লেখক কুণাল ঘোষ স্বীকোরক্তি, ”প্রচেতদা গল্প লেখার টানে চরিত্র তৈরি করে নেন। তেমন ক্ষমতা আমার করায়ত্ত হয়নি। চারপাশে যে সমস্ত চরিত্ররা আছে, তা থেকেই আমি গল্প বুনতে শুরু করি।”
সাংবাদিকতার কাজে সদা ব্যস্ত। লেখালেখির সময় পান কম। তবু এরই মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর পনেরোটি গল্প। একডজন উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। সম্প্রতি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘রানিসাহেবা’ গ্রন্থটি। যে গল্পে বিদ্যমান দু’টি নারী চরিত্র। লেখক জানিয়েছেন, ”এই দুই চরিত্রের কেউই আমার কাল্পনিক নয়।” খবর খুঁজতে গিয়ে হাতে এসেছিল পুরনো দলিল। তা ঘেঁটে দুঁদে সাংবাদিক খুঁজে পেয়েছিলেন ইতিহাস। ১৭৯৭ সালে মেদিনীপুরের কর্ণগড়ের রানি শিরোমনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। যা ঝাঁসির রানির থেকেও অনেকটাই আগে। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন লেখক। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে জানিয়েছিলেন বিষয়টি। সাংবাদিক কুণাল ঘোষের অনুরোধে সেখানে গিয়েওছিলেন তিনি। রানির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করেছিলেন শিরোমণি এক্সপ্রেস। তারপর? ‘‘বিতর্কিত বন্দি জীবনে রাজনৈতিক বন্দীদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাই। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে খোঁজ পাই অন্ধ্রপ্রদেশের এক গ্রামের।’’ জানিয়েছেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক। ১৭৯৭ সালের সঙ্গে বর্তমান সময়কে মিলিয়েছে কুণাল ঘোষের কলম।
সাহিত্যিক গৌর বৈরাগী রসকসহীন ইন্টারনাল অডিট বিভাগে চাকরি করতেন। সে সময় মাথায় একটি ভূত চেপেছিল। সাহিত্যের ভূত। সেখানেই খোঁজ পান এক সাহিত্যিকের। সেই বৃন্দাবন চন্দ্র বাগচিকে খুঁজতে গিয়েই তৈরি হয়েছিল তাঁর গল্প। এভাবেই জীবনের নানান ওঠাপড়া শব্দ দিয়ে বেঁধেছেন সাহিত্যিকরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.