Advertisement
Advertisement

Breaking News

ভাদু উৎসবের

আদর-আড়ম্বর ফিকে, তবু সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে মানভূমের চিরায়ত ভাদু

ঐতিহ্যের গানগুলি সংরক্ষণে উদ্যোগী পুরুলিয়ার মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়।

People of Purulia, Bankura celebrate traditional Vadu festival
Published by: Sucheta Sengupta
  • Posted:September 17, 2019 6:03 pm
  • Updated:September 18, 2019 1:01 pm  

সুমিত বিশ্বাস ও টিটুন মল্লিক: নদীর ধারে একটু জটলা। দূর থেকে ভেসে আসে গান – “কাশীপুরের রাজার বিটি/বাগদি ঘরে কী কর?/কলসী কাঁখে লয়ে পরে/ সুখ সাগরে মাছ ধর।” সারিবদ্ধ মহিলাদের কোলে-কাঁখে ছোট্ট মূর্তি। যেন কচি মেয়েকে কোলে নিয়ে জলাধারে গিয়েছেন মায়েরা। কার মেয়ে কত ভাল, সেই নিয়ে গান বেঁধে লড়াই চলে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই এই গানের রেশ কেটে যায়। জলে ফেলে মেয়ের বিসর্জন হয়ে যায়। চেনা লাগছে গল্পটা? দুর্গা বিদায়ের সঙ্গে মিল পাচ্ছেন?

ঠিকই ধরেছেন। ভাদ্রের সংক্রান্তিতে লালমাটির দেশে এ এক পরিচিত আবহ – ভাদু উৎসব। শেষ থেকে শুরু কিংবা শুরু থেকে শেষ, যেটাই মনে করা হোক, দেবী দুর্গার আবাহন-বিসর্জনের মতো শস্যদেবী আসেন, আবার চলে যান। উমার মতোই ভাদুও আমবাঙালির ঘরের মেয়ে। লোক উৎসবের কাহিনিতে কান পাতলে শোনা যায়, কাশীপুরে পঞ্চকোট রাজবংশের রাজা নীলমনি সিং দেও-র কন্যা ভদ্রেশ্বরী। যদিও এ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ক সরিয়ে রেখেই শুধুমাত্র কাহিনির মাধুর্যেই এই পার্বণ হয়ে উঠেছে চিরায়ত, লোকায়ত। তো সেই রাজা নীলমণি সিং দেও কিশোরী কন্যার অকাল প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতি আঁকড়ে রাখতে ভাদু উৎসবের প্রচলন করেন। এখন তাই কাশীপুরেই সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে ভাদুর নিয়মনীতি পালন।

Advertisement

[আরও পড়ুন: টানা বৃষ্টিতে জলস্তর বাড়ছে ডুয়ার্সের নদীর, বিপর্যস্ত জনজীবন]

কিন্তু বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলায় উৎসবের আনন্দ কি কম পড়িয়াছে? মোটেই না। তাই তো রুখুসুখু মাটিতে কয়েকদিনের জন্য বেজে ওঠে আনন্দসুর। এবারও তাই। ভাদ্র সংক্রান্তির ঠিক আগে পুরুলিয়া, বাঁকু়ড়ায় পুরোদমে চলছে ভাদুর আরাধনা। তবে এই আনন্দের একতারাতেও আজকাল বিষাদ বেজে ওঠে। না আছে সেকালের গানের কথা, না আছেন গায়ক। ভাদু উৎসব যেন অনেকটাই পঞ্জিকায় পিঞ্জরাবদ্ধ। অথচ সেসব কী দিন ছিল! প্রাণের উৎসব ভাদুকে সামনে রেখে পুজোপাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ, ধর্মীয় আড়ম্বর, ভোজন – কিছুই বাদ পড়ত না। মেয়ে-বউদের প্রাণের সুর বসানো গানে গানে যেন হঠাৎই সজীব হয়ে উঠত চারপাশ। কিন্তু আজ গান আছে, প্রাণ নেই, সুর গেছে কেটে।

এখন ভাদুর সুরে শোনা যায় বিজ্ঞাপনের কথা – “সিম এসেছে জিও/ এবার কিন্তু যাবার আগেই আমায় একটা দিও/ গত বছর স্পিড ছিল না/ টুজি–থ্রিজির জন্য/ ফোর জি যখন এসে গিয়েছে/ এবার ব্যাপার অন্য।” সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাজ ঘরানা-সহ সমসমায়িক গানকে দু’মলাটে বন্দি করতে কাজ শুরু করেছে পুরুলিয়ার কাশীপুরের মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়। অধ্যক্ষ বিভাসকান্তি মণ্ডল বলেন, “আমাদের কলেজে ভাদু গানে যে ডিপ্লোমা কোর্স চলছে সেখানে পাঠরত ছাত্রছাত্রীরা একাল–সেকালের প্রায় সমস্ত ভাদু গান সংগ্রহ করছে। তারপর আমরা এই গানের একটা সংকলন করব। যদিও পঞ্চকোট রাজঘরানার ভাদু গান নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই ১১৮টি গানের সংকলন করেছি। এই উৎসবের জৌলুস ধরে রাখতে হলে গানকে বাঁচাতেই হবে।” আগে পয়লা ভাদ্র থেকেই ভাদুর মূর্তি কিনে ফি সন্ধ্যায় প্রায় রাত পর্যন্ত গান গাইতেন মহিলারা। কাশীপুরের ন’পাড়ার বাসিন্দা শিবানী বাউড়ি বলেন, “আমাদের গান গাওয়ার সঙ্গীরা সব ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছেন। অনেকে মারাও গিয়েছেন। তাই আর আগের মত সমগ্র ভাদ্র মাস জুড়ে গান হয় না। এখন কেবল ভাদ্র শেষে জাগরণেই আটকে গিয়েছে ভাদু গীত।” লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায়ের কথায়, “তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর বলেছিল, ভাদু গানকে সংরক্ষণ করতে তারা একটা সংকলন করবে। কিন্তু আজও সেই কাজ এগোয়নি। তবে আমার কাছে সংগ্রহ করা আড়াইশো গান রয়েছে।” সেই গানে–গানেই হয়ত আজকের রাত্রি জাগরণ পঞ্চকোটের।
আর উৎসব মানেই তো পেটপুজো। তাই ভাদুকে সামনে রেখে খাজা, কোস্তা, লবঙ্গ লতিকা, গজা, মতিচুরের লাড্ডু, চিনির পুতুল। ভাদুর জাগরণ–বিসর্জনে এই হরেকরকম মিষ্টান্নতে ম–ম করত পঞ্চকোট। এই পঞ্চকোটের রাজসভায় ভাদু উৎসবে পঁচিশ কেজির লাড্ডু তৈরি হত। ভাদুকে দেওয়া হত একান্ন রকমের মিষ্টি। কিন্তু আজ সেসব অতীত। ভাদু জাগরণে মিষ্টি নিয়েও শোনা গেল গান। এই মিষ্টি নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। এই পরবের মিষ্টি চেখে দেখতেন স্বয়ং ছোটলাটও। তাই ভাদু পরবের মিষ্টি বানানোকে ঘিরে কম তোড়জোড় ছিল না এই ভাদুভূমে। সেইসময় পুরুলিয়ার কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজপরিবারে যে দোকান থেকে মিষ্টি যেত, সেই দোকানের বর্তমান মালিক চিত্তরঞ্জন দাস মোদক বলেন, “ভাদু–র সময় ছোটলাটের কাছে মিষ্টি পাঠানো হত। দু’কেজি ওজনের লাড্ডু, থালার মত জিলিপি দোকানে সুতোয় বেঁধে ঝোলানো থাকত। এমনকি লাড্ডু–জিলিপির নিলাম হত। সারা ভাদ্র মাস জুড়ে যে কত রকমের মিষ্টি তৈরি করতেন বাপ–ঠাকুরদা! এখন সেসব শুধুই স্মৃতি।”

[আরও পড়ুন: নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর ই-মেল হ্যাক, মোটা অঙ্কের টাকা চেয়ে মেল ঘনিষ্ঠদের]

এসব কথা শুনতে শুনতে ভাদুর রেশ ধরে আমরা পৌঁছে যাই পাশের জেলা বাঁকুড়ায়। ছাতনা থানার কেঞ্জাকুড়ার মিষ্টি ঘিরে গানও রয়েছে। “অবাক দেখে শুনে/ কেঞ্জাকুড়ার অশোক দত্তের দোকানে/ বড়–বড় জিলিপি গুলা সওয়া কেজি ওজনের/ আবার খাজা গুলা এক ফুট করে/ দেখে এলাম নয়নে।” পঞ্চকোট ইতিহাস গবেষক দিলীপ গোস্বামীর কথায়, “ভাদু কোনও উপোষ করার পরব নয়। এই উৎসব উচ্ছ্বাসের, উল্লাসের। তাই তো ভাদুকে ঘিরে এমন মিষ্টান্নের আয়োজন। ভাদুর মিষ্টির সেই জৌলুস এখন না থাকলেও ঐতিহ্য কিন্তু রয়েই গিয়েছে।” সেকালের ভাদুর স্পেশ্যাল মিষ্টি ছিল আঁকরা মিঠাই। হাড়ি, গ্লাসের মত আকৃতির এই মিষ্টি বিক্রি হত। তবে সেই আঁকরা মিঠাই না থাকলেও ভাদু–র জিলিপিতে এখনও পাক দেয় এই সাবেক মানভূম। বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়া ‘শিল্পগ্রাম’ হিসাবে পরিচিত। কর্মের দেবতা বিশ্বকর্মার আর শস্যের দেবী ভাদুর আরাধনায় মেতে উঠেছেন বাসিন্দারা। এই দিনটিতে এই শিল্পগ্রামে শুরু হয়ে যায় জিলিপি উৎসবে। দু–কেজি, আড়াই কেজি, তিন কেজি ওজনের একেকটা জিলিপি।

jilipi

গরম রসের কড়াইয়ে এহেন জাম্বো জিলিপি টগবগ করে ফুটতে দেখে জিভে জল আসবেই, সেকথা হলফ করে বলা যায়। মাত্র আড়াই প্যাঁচেই কুপোকাত। বেশ লাল করে ভাজা মুচমুচে বড় সাইজের জিলিপি কে কতগুলো বানাতে পারে, তা নিয়ে যেন একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এই শিল্পগ্রামে।প্রতিবছরের মতো এবছরও রেওয়াজ মেনে শুধুমাত্র বানানোর প্রতিযোগিতাই নয়,পদ্মপাতায় মুড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বাড়িতেও পাঠাচ্ছেন কেঞ্জাকুড়া বাসিন্দারা। নগর-সভ্যতার দাপটে লোকায়ত এই উৎসবের উদযাপন ফিকে। তবু শেষপর্যন্ত ফিকে ভাব কোনও প্রতীক নয়। বছর ফিরলেই আবার আসবেন চিরায়ত ভাদু। বাঁধা হবে গান।

ছবি: অমিত সিং দেও।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement