নিজস্ব চিত্র
বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: অসাধারণ হয়েও অদ্ভুত সাধারণ! কিছুদিন আগে পদ্মশ্রী সম্মান পেয়েছেন। তার লেখা উপন্যাস ‘ডয়ামারা নদী তীরে সোনম মালতি প্রেম কথা’ সিনেমার পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাঁর টানেই পাহাড়ি ছোট্ট গ্রামে এখন দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। তবু মন ভালো নেই পদ্মশ্রী ধনীরাম টোটোর (Dhaniram Toto)। কে বলবে জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরের গবেষক মহলে সমাদৃত মানুষটির এত সাধারণ জীবনযাপন। সেই তো সস্তা জামা, জ্যাকেট গায়ে। পড়নে কোচকানো ফুলপ্যান্ট। পায়ে চপ্পল। অবিন্যস্ত কাচাপাকা চুল। রাতদিন কতশত আমন্ত্রণ। কিন্তু শহরে মন যেতে চায় না। সাফ হয়ে যাওয়া জঙ্গল দেখে এখনও শিশুদের মতো কাঁদেন। বয়স সঙ্গ না দিলেও সবুজ রক্ষার জন্য ইচ্ছে করে বিদ্রোহ ঘোষণার। ঠিক যেমনটি তার ‘ধানুয়া টোটো কথামালা’ উপন্যাসে ধানুয়া সাহেবদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে আশ্রয় নিয়েছিল জঙ্গলে।
জলদাপাড়া থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার দূরের টোটোপাড়া গ্রামে হামেশাই হাতি চলে আসে। কাঠে দ্বিতল বাড়ির দাওয়ায় বসে পদ্মশ্রী সম্মান, শংসাপত্র দেখানোর ফাঁকে ধনীরামবাবু বললেন, “আমরা হাতি, বাঘের সঙ্গে থাকতে অভ্যস্ত। ওরা জঙ্গলে থাকবে আমরা গ্রামে থাকব। এটাই নিয়ম। কিন্তু জঙ্গল যদি না থাকে তবে ওরা থাকবে কোথায়? ওদেরও পেট আছে, অধিকার আছে। কেউ ভাবছে না কেন ওদের কথা?” এরপরই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সরল দাবি, “আমাদের সেই জঙ্গল ফিরিয়ে দিতে হবে।”
দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধনীরাম টোটোর পড়াশোনা। অথচ তার অধীনে ছজন টোটো সমাজের উপরে পিএইচডি করেছেন। বাবা আমেকা টোটো ছিলেন গাও বুড়ো। ১৯৭৬ সালে মারা যান। তিনি নিজে অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ ও আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের কর্মী ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান ভাষাবিদ টোবি অ্যান্ডারসনের সহযোগিতায় টোটো ভাষার স্ক্রিপ্ট ও হরফ তৈরি করেন। রচনা করেন টোটো ভাষার সম্পূর্ণ বর্ণমালা। তবে নতুন করে আর গবেষণার ইচ্ছে নেই ধনীরামবাবুর।
আধুনিকতার ধাক্কায় পালটে যাওয়া সামাজিক পরিস্থিতি দেখে ধনীরাম টোটো রীতিমতো হতাশ। এক সময় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন। এখন ভয়ে কিছু বলেন না। কেন? তার কথায়, “এখন টোটোপাড়ায় দশজন স্নাতক আছে। কয়েকজন এমএ পড়ছে। প্রত্যেকে বেকার। আমার ছোট ছেলে ধনঞ্জয় টোটোদের মধ্যে প্রথম স্নাতকোত্তর। লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়েছে। চাকরি নেই। গ্রামেও কাজ নেই।” তবে ছেলেরা কি করছে? পদ্মশ্রী হাসেন। উদাস চোখে তাকিয়ে বলেন, “জীবন ধারণের জন্য ছেলেরা কাজের খোঁজে বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিক হচ্ছে। আমার ছেলেও সিকিমে চলে যেতে চাইছে।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.