বিশ্বদীপ দে: ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৪। থিয়েটার দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (Ramakrishna)। কিন্তু তাঁর সামনে বসে থাকা ভক্তমণ্ডলীর সকলেই যে ঠাকুরের সেই ইচ্ছাকে সেদিন মেনে নিতে পারছিলেন তা নয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত তথা শ্রীম’র লেখা ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-তে রয়েছে ‘ঠাকুর হাসিতেছেন। কেহ কেহ বলিলেন, বেশ্যারা অভিনয় করে। চৈতন্যদেব, নিতাই এ-সব অভিনয় তারা করে।’ উত্তরে রামকৃষ্ণ সেদিন বলেছিলেন, ”আমি তাদের মা আনন্দময়ী দেখব। তারা চৈতন্যদেব সেজেছে, তা হলেই বা। শোলার আতা দেখলে সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়।”
আমরা জানি, ‘চৈতন্যলীলা’ দেখতে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ঠাকুর। মূল চরিত্রের অভিনেত্রীকে আশীর্বাদ করেছিলেন ‘চৈতন্য হোক’ বলে। সেদিনের সেই ঘটনা কার্যতই এক মৌখিক ইতিহাসের মতো মিশে রয়েছে বঙ্গজীবনের চিরকালীন অন্দরে। স্বয়ং অভিনেত্রীও তাঁর আত্মজীবনীতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেদিন মঞ্চের ‘চৈতন্য’কে রামকৃষ্ণ প্রথমে পুরুষ বলে ভুল করেছিলেন। পরে জানতে পারেন ওই অভিনয় করেছেন এক বছর বাইশের তরুণী। আমরা জানি তিনি আর কেউ নন। কিংবদন্তি অভিনেত্রী নটী বিনোদিনী (Noti Binodini)।
তাঁর বারো বছরের অভিনয় জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল ২৫ ডিসেম্বর। সেই ঘটনার ১৩৬ বছর হল। অভিনয় শুরু ১৮৭৪ সালে। ‘শত্রুসংহার’ নাটকে। দ্রৌপদীর সখীর ভূমিকায়। শুরুতে মাসিক বেতন ছিল দশ টাকা। জীবনের দ্বিতীয় নাটকেই পান নায়িকার রোল। এবং মাতিয়ে দেন। স্টার থিয়েটার গড়ে উঠতে তখনও ঢের দেরি। সেই সময় বিনোদিনী গ্রেট ন্যাশন্যাল থিয়েটারে। তাঁর জন্ম ১৪৫ কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে। সেটা উত্তর কলকাতার ‘রেড লাইট এরিয়া’। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। কিন্তু মঞ্চে যেভাবে দাপটের সঙ্গে বিভিন্ন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তা বুঝিয়ে দেয় ভিতরে ভিতরে আত্মবিশ্বাসের আগুন কতটা গনগনে ছিল।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ সাতটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। আবার ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নাটকে দু’টি চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। আয়েষা ও তিলোত্তমা দুই-ই তিনি। একই রাতে মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্রে তাঁর অভিনয়ের দীপ্তি দর্শককে মুগ্ধ করত। শুধু একই নাটক নয়, বিভিন্ন নাটকে। কেবল এইটুকুই বুঝিয়ে দেয় তাঁর অভিনয়ের ‘রেঞ্জ’টা। করুণ থেকে হাস্যরস, সব ধরনের অভিনয়েই কাঁপিয়ে দিতেন মঞ্চ।
এহেন অভিনেত্রী যে অল্পদিনেই নাম করে ফেলবেন তা বলাই বাহুল্য। খুব দ্রুতই সেকালের সংবাদপত্রে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘ফ্লাওয়ার অব দ্য নেটিভ স্টেজ’ কিংবা ‘প্রাইমাডোনা অফ দি বেঙ্গলি স্টেজ’। তাঁর এই উত্থানের পিছনে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদানের কথাও সর্বজনবিদিত। ১৮৭৭ সালে তাঁর সংস্পর্শে আসাই বিনোদিনীর জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’। বেঙ্গল থিয়েটারের ‘কপালকুণ্ডলা’ নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় দেখার পর তিনি থিয়েটারের মালিক শরৎ ঘোষকে বলেছিলেন, ”বেঙ্গল থিয়েটার থেকে ওকে ছেড়ে দাও, নতুন জায়গায় ওর মাইনে অনেক বেড়ে যাবে।” সেই সময় বেঙ্গল থিয়েটার থেকে মাইনেও অনিয়মিত। গিরিশের সংস্পর্শে সব দিক থেকেই বদলে যায় বিনোদিনীর জীবন।
সেকথা কখনও ভোলেননি বিনোদিনী। ‘গুরু’র প্রয়াণ যে তাঁর কাছে কত বড় বেদনার, তা ফুটে ওঠে অভিনেত্রীর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’য়। বইয়ের একেবারে শুরুতেই তিনি লিখেছিলেন, ‘রঙ্গালয়ে আমি গিরিশবাবু মহাশয়ের দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলাম। তাঁহার প্রথমা ও প্রধান ছাত্রী বলিয়া একসময় নাট্যজগতে আমার গৌরব ছিল। আমার অতি তুচ্ছ আবদার রাখিবার জন্য তিনি ব্যস্ত হইতেন। কিন্তু এখন সে রামও নাই, সে অযোধ্যাও নাই!’
এবং শ্রীরামকৃষ্ণ। অসামান্যা এই অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন ঠাকুরের পরম স্নেহের পাত্রী। যেকথা এই লেখার শুরুতেই আমরা বলেছি। ব্রজেন্দ্রকুমার দে’র লেখা নট্ট কোম্পানির সেই বিখ্যাত যাত্রাপালা ‘নটী বিনোদিনী’র দৃশ্যটি স্মরণ করা যাক। রামকৃষ্ণ জানতে চাইছেন, ”নিমাই কে সেজেছিল গো?” তাঁর সামনে তখন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া বিনোদিনী। রামকৃষ্ণ যখন জানতে পারেন বিনোদিনীর কথা, অবাক হয়ে বললেন, ”মেয়ে! খুব ঠকিয়েছিস তো!” সেদিন অভিনেত্রীর মাথায় হাত দিয়ে তিনি আশীর্বাদ করায় বিনোদিনী অবাক হয়ে জানতে চান, ‘আমি মহাপাপী- আমাকেও তোমার এত কৃপা?’ উত্তরে ঠাকুর বলেন, ”পাপ নেই, পাপ নেই। তিনিই সব হয়েছেন। আসল নকল এক হয়ে গেছে।”
বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘চৈতন্যলীলার অভিনয়ে, শুধু চৈতন্যলীলার অভিনয়ে নহে আমার জীবনের মধ্যে চৈতন্যলীলা অভিনয় আমার সকল অপেক্ষা শ্লাঘার বিষয় এই যে আমি পতিতপাবন পরমহংস দেব রামকৃষ্ণ মহাশয়ের দয়া পাইয়াছিলাম। কেননা সেই পরম পূজনীয় দেবতা চৈতন্যলীলা অভিনয় দর্শন করিয়া আমায় তাঁর শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় দিয়াছিলেন।’ সেদিন বিনোদিনীর সামনে এসে রামকৃষ্ণদেব ‘হরি গুরু, গুরু হরি’ বলে নেচে উঠেছিলেন। তারপর দুই হাত তাঁর মাথায় দিয়ে বলেছিলেন, ”মা, তোমার চৈতন্য হউক।” সেদিন ঠাকুরের ‘করুণাময় দৃষ্টি’র কৃপা লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন বিনোদিনী। লাভ করেছিলেন তাঁর অভিনয় জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
এমন রঙিন তাঁর অভিনয় জীবন। তবু মাত্র ২২-২৩ বছর বয়েসে স্টেজ ছেড়ে চলে যান তিনি। আর কখনও ফিরে আসেননি। আজকের দিনে যে বয়সে অভিনয়ের কেরিয়ার হয়তো সবে শুরু হয়, সেই বয়সেই রঙ্গমঞ্চকে বিদায় জানিয়েও তিনি কিংবদন্তি। এর ঠিক বছর দুয়েক আগেই তৈরি হয়েছিল স্টার থিয়েটার। যে থিয়েটার তৈরির পিছনে বিনোদিনীর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনকী স্টার থিয়েটারের পরিবর্তে নতুন সেই রঙ্গালয়ের নাম তাঁর নামের আদ্যাক্ষর মিলিয়ে হওয়ার কথা ছিল ‘বি থিয়েটার’। তা হয়নি। এর পিছনে রয়েছে এক ধরনের ‘প্রতারণা’র কাহিনি। সেখানে শামিল গিরিশ ঘোষও! সেই বেদনাকে আজীবন সঙ্গী করেই আর কখনও অভিনয় করেননি বিনোদিনী। ১৮৮৬ সালের ২৫ ডিসেম্বরই ছিল তাঁর অভিনয় জীবনের শেষ দিন। কিন্তু নাটকের প্রতি ভালবাসা কখনও ফুরোয়নি। অহেন্দ্র চৌধুরীর স্মৃতিকথায় রয়েছে, ‘বিনোদিনী প্রায়ই থিয়েটার দেখতে আসতেন, যথেষ্ট বৃদ্ধা হয়েছেন, কিন্তু থিয়েটার দেখবার আগ্রহটা যায়নি। নতুন বই হলে তো উনি আসতেনই…’ শোনা যায়, স্টার থিয়েটারের (Star Theatre) দারোয়ানদের নির্দেশ দেওয়া ছিল, উনি যখনই আসুন, যেন ঢুকতে দেওয়া হয়। কেননা সকলেরই জানা ছিল, এই মানুষটি না থাকলে স্টার থিয়েটার হতই না।
১৯৪১ সালে প্রয়াত হন বিনোদিনী। তারপর কেটে গিয়েছে আট দশক। আজও বঙ্গ সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়ে রয়ে গিয়েছেন তিনি। বাংলার রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস তাঁকে বাদ দিয়ে যে হতে পারে না, আজও এই বিষয়ে নিঃসংশয় সকলে। তিনি আজও অপরাজিতা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.