নির্মল ধর: মঞ্চে নাটক প্রযোজনা একাধারে যেমন সমাজ শিক্ষার বিষয়, তেমনই বিনোদনের বিষয়ও বটে। নাটকের বিনোদন গুণকে অস্বীকার করা যায় না। সেই সঙ্গে নাটক চলমান সমাজের চিত্র তুলে ধরবে এটাও কাম্য এবং সঙ্গে দর্শকের সামনে নিয়ে আসবে সেই বাস্তব ছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকা মানুষগুলোর সুখ, দুঃখ, বেদনা, আনন্দঘন মুহূর্তগুলো। যা কিছুটা মন ভালো করা বা “মন কেমন করে ওঠা”র অনুভূতি।
উষ্ণিক প্রযোজিত নতুন নাটক (Drama Review) “না – কথা” আজকের কোভিড আবহে গৃহবন্দী হয়ে থাকা দুটি বয়স্ক মানুষ মানুষীর পারস্পরিক নির্ভরতার এক সুষম চিত্র তুলে এনেছে। বিপত্নীক অধ্যাপক এবং তাঁর পঁচিশ বছরের একান্ত সচিব মণির সঙ্গে সম্পর্কটা একই সঙ্গে তিক্ত এবং দুজনেরই অন্তরের অন্তস্থলে কোথায় যেনো বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার না বলা কথায় জড়ানো! ঈশিতা মুখোপাধ্যায় নিজেই নাট্যকার – পরিচালক। তাঁর কল্পনা শক্তি এবং কলমের আঁচড় দুটোই বেশ সাবলীল, সহজ, প্রাণময়, স্বচ্ছন্দ এবং এখনকার জীবনধারার প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে। শুরু থেকেই নাটকের চলনকে ঈশিতা শক্ত হাতে পরিচালনার আন্তরিক ভালোবাসা দিয়ে নরম হাতে যেনো আদর করেছেন পুরো একটি ঘণ্টা। মুহূর্তের জন্যও ছন্দপতন ঘটেনি, ঘটনার বিন্যাসে, সংলাপের সাম্প্রতিকতায় সত্যই বেশ জমজমাট। প্রযোজনাটি আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে দুই অভিনেতার (শুভাশিস মুখোপাধ্যায় এবং সীমা মুখোপাধ্যায়) সাবলীল, প্রাণবন্ত চরিত্রায়ানে। একটু ইনেস্ট্রিক ধরনের অধ্যাপক তাঁর প্রাত্যহিক জীবনে সচিবের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল, অতিমারির জন্য তো আরও বেশি। সামাজিক লক ডাউন তাদের দুজনকে লক করে দেয় একটি ঘরে।
অধ্যাপকের জীবনে সচিব মণি তখন ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অনিবার্য সঙ্গী। বিদগ্ধ এবং বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকের সঙ্গে সাধারণ গ্রাজুয়েট মণির জীবনের গভীর চিন্তা ও দর্শনে অমিল থাকলেও, যুথবদ্ধ একঘরের জীবনে পারস্পরিক নির্ভরতাই দুজন মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র “ছ্যা”! যে শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন অধ্যাপক।
শুধু দুজনের না-বলা সম্পর্কের রঙিন বাতাস বয়ে যায় না একাডেমি মঞ্চ জুড়ে, একই সঙ্গে উঠে আসে
আতিমারির অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক, ভয়াবহ পরিবেশটিও। গত পঁচিশ বছর ধরে সচিব শুধু চাকরির কর্তব্যই করে গিয়েছেন, নাকি তাঁর দিনলিপির মধ্যে জড়িয়েছিল না কথার সেই “ছ্যা”!! হ্যাঁ, সেটাই ছিল, ছিল বলেই, লকডাউন উঠে গেলে অধ্যাপকের বাড়ি ছাড়তে পারেনি সচিব মণি, এবং অধ্যাপকও বার বার পিছু ডেকেছেন!! এই অন্তিম মুহূর্তটি আসবেই, এটা দর্শকের বুঝতে অসুবিধে হয়নি, কিন্তু ওই মুহূর্তটি গড়ে তোলার নাটকীয়তা সত্যিই বাহবা যোগ্য। ঈশিতার আন্তরিক এবং পরিচ্ছন্ন পরিচালনার গুনে “না – কথা” হয়ে ওঠে মন কেমন করা নয়, মন ভাল করার এক ভারহীন নির্ভেজাল নাটক। আজকের এই ভীত আতংকিত দুঃসময়ে এক হৈমন্তী আনন্দের হাওয়া।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.