নির্মল ধর: নবম শতকের তামিল ‘মহাভারত’-এ নাকি ‘কালাপ্পালি’ নামে একটি প্রথার উল্লেখ আছে! যুদ্ধের আগে দেবী কালীর সামনে কোনও বীরকে যদি বলি দেওয়া যায়, তাহলে সেই পক্ষের জয় অনিবার্য। পাণ্ডবরা নাকি অর্জুন-উলুপীর সন্তান ইরাবানকে মহাযুদ্ধের আগে বলি দিয়েছিল। সেই আখ্যান নিয়েই চন্ডীতলা প্রম্পটারের প্রযোজনায় নতুন নাটক ‘ইরাবান গাথা’ (Irban Gatha)।
ক’দিন আগেই নাটকটি অভিনীত হল অ্যাকাডেমি মঞ্চে। সার্বিক সৃজনে রাকেশ ঘোষ (Rakesh Ghosh)। মহাভারত আশ্রিত কাহিনি হলেও ‘ইরাবান গাথা’কে সাম্প্রতিক করে তোলার চেষ্টা করেছেন নাট্যকার। ক্ষমতার লিপ্সা শাসকের চিরন্তন এবং শাসনের জন্য সাধারণ মানুষকে শুধু ব্যবহার করে যায়। সেই ব্যবহারে ধর্ম, জাতপাত, ধনী-গরীবের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভেদাভেদ তৈরি করাটাই শাসনের মূলমন্ত্র। পুরানকাহিনিকে ঠিক তেমন ভাবেই বদলে নেবার চেষ্টা, আজকের কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের উল্লেখ করে নাটকটির গায়ে আজকের পোশাক পরানোর চেষ্টা অবশ্যই অভিনব এবং অভিনন্দনযোগ্য।
অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতীকী মঞ্চে দর্শক দেখলো উলুপী-কৃষ্ণ-ইরাবানের ত্রিমুখী সংগ্রাম, সংঘাত এবং তাঁদের পারস্পরিক তর্ক-বিতর্কের সঙ্গে এক অন্যরকম ডিস কোর্স। ইরাবান নিজেই অত্যন্ত কৃষ্ণভক্ত। সুতরাং পাণ্ডবদের বলি প্রদানের উদ্দেশ্য জেনেই রাজি হয়ে যান। কিন্তু ইরাবানের শর্ত ছিল এক রাতের জন্য হলেও তাঁর বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কোনও বাবাই চায়নি নিজের সন্তানের নিশ্চিত বৈধব্য জেনেও তাঁর মেয়েকে ইরবানের সঙ্গে বিয়ে দিতে। অগত্যা, শ্রীকৃষ্ণ নিজেই মায়ায় ‘মোহিনী’ হয়ে ইরাবানের জন্য একরাতের স্ত্রী হন। কিন্তু, বাসর রাতেই ইরাবান বুঝতে পারেন মোহিনির শরীরে শ্রীকৃষ্ণের গন্ধ ও বর্ন। এরপর সন্তানহারা উলুপি আসে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মোকাবিলা করতে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ যে জাঁদরেল রাজনীতিক,
এবং আরও বড়ো কূটনীতিক। তর্কে উলুপিকে হার মানতেই হয়।
নাট্যকার রাকেশ ঘোষ মহাভারতের ঘটনাকে আজকের প্রেক্ষিতে প্রোথিত করতে গিয়ে বাল্যান্স রাখতে পারেননি। বিশেষ করে শেষ পর্বে। এই ত্রুটিটুকু সরিয়ে রাখলে চন্ডীতলা প্রম্পটার এর এই প্রযোজনা এবং সার্বিক উপস্থাপনা নিশ্চয়ই মনে রাখার মতো। নাটকটির গ্রন্থণার পাশাপাশি অবশ্যই স্বীকার করতে হবে শিল্পীদের সামগ্রিক অভিনয়ের কথা। বিশেষ করে কল্পনা বড়ুয়া উলুপীর চরিত্রে খুবই দাপট নিয়ে অভিনয় করেছেন। কৃষ্ণর সঙ্গে তাঁর মোলাকাতের দৃশ্যটি অবশ্যই নাটকের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।
শ্রীকৃষ্ণ হয়েছেন রঞ্জন বোস। তিনি কৃষ্ণ হয়ে বাকপতুটায় যেমন কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তেমনই ‘মোহিনী’ সাজে প্রেমের ছলাকলা প্রকাশেও তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। অন্যতম প্রধান চরিত্র ইরাবানের ভূমিকায় রয়েছেন কৌস্তভ মজুমদার। তিনি প্রথম দিকে একটু নিষ্প্রভ ছিলেন, পরে চরিত্রটির দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও নিশ্চিত পরিণতি জেনে ইরাবানের অস্বস্তি ও সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনার জায়গাগুলো সুন্দর ভাবেই প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও প্রদীপ রায়(দূত), কৃষ্ণেন্দু ভট্টাচার্য(অর্জুন) ও কৌশিক মালের (ভীম) অভিনয় ভাল লেগেছে। সংগীত আয়োজনে ছিলেন অভিজিৎ আচার্য। তাঁর সুরে স্তোত্রপাঠ সুন্দর, কিন্তু একটি গান যেন অতিরিক্ত মনে হল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.