সন্দীপ্তা ভঞ্জ: হাতে কলকে। গলায় জড়ানো সাপ। জটাধারী ভোলে বাবা, তবে শারীরিক গড়নে ‘সিক্স প্যাক’-এর ছাপ! কী সব্বনেশে কাণ্ড! ও লো… এ কী আমাদের ঘরের জামাই? ও দুগ্গা দেখ তো ভাল করে…! পুরাণ হোক বা যে কোনও প্রাচীন পুঁথি, শিব ঠাকুরের শারীরিক গঠনের যেরকম বর্ণনা সাধারণত আমরা পেয়েছি, তা কিছুটা এরকম – ভারী চেহারা, মোটা গোঁফ, আদ্যোপান্ত বাঙালি ঘরের পুরুষের মতো মধ্যপ্রদেশে কিঞ্চিৎ ভুঁড়ি।
কিন্তু কালের নিয়মে টেলিভিশন থেকে বইপত্তর – সবেতেই শিবের শারীরিক গঠনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। উনিও এখন আমাদের মতোই ‘স্বাস্থ্য সচেতন’। জিমে গিয়ে শরীরের বাড়তি ওজন ঝরিয়ে একেবারে ঝরঝরে চেহারা। কিন্তু, সেই গাজনের মেলায় সেজে দাঁড়িয়ে থাকা ‘মোটাসোটা ভদ্রলোক’টির আমেজটা কেমন যেন আর নেই! স্লিম শিব! আর শিব ঠাকুরের এই শারীরিক গড়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলে বেজায় বিপাকে পড়েছেন তৌসিফ হক নামে এক শিল্পী।
‘তৌসিফ হক’ নামটাই কি তাহলে আসল আপত্তির কারণ? সেই প্রশ্ন অনেকেই তুলেছেন। তবে ওই ছবির সঙ্গে তৌসিফ যে লেখাটি জুড়েছেন, তাতে কিন্তু এটাই মনে হয়েছে যে বিভিন্ন পুরাণ এবং অন্নদামঙ্গলের বর্ণনাকে আধার করেই শিল্পী নিজের কল্প জগতে শিবের এই অবয়ব দিয়েছেন। শিল্পীর চেতনায় শিব কখনওই ‘সিক্সপ্যাকওয়ালা’ ছিলেন না। তাঁর বর্ণনায়, “বাঙালির শিব ঠাকুর কখনও মাসলওয়ালা মাস্তান নন বরং তিনি শান্ত, মাথায় জটা, চেহারা একদম নাদুস-নুদুস। ভুঁড়ি আছে এবং তিনি সম্ভ্রান্ত চাষী, কৃষিকাজের মাঝে লাল শালু মুড়ে গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত থাকেন। তিনি একাধারে প্রেমিক এবং সৎ, অন্যদিকে দয়ালু পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক।”
তৌসিফের কথায়, “ওই ভয়ংকর সিক্সপ্যাক শিব, ওটা আমাদের বাংলা ও বাঙালির শিব নন, ওটা উত্তর ভারত থেকে এখানে আমদানি করা হয়েছে।” এই শেষ লাইনটি লিখেই বোধহয় গেরুয়া শিবিরের রোষানলে পড়েছেন। অনেকেই আবার উপাস্য দেবতাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হয়েছে বলে চোখ রাঙিয়েছেন। অতঃপর, শিল্পীর শৈল্পিক চেতনাকে মর্যাদা দেওয়ার পরিবর্তে ফেসবুকে পরের পর এমনভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে যে তৌসিফের প্রোফাইল আপাতত ব্লক করে দেওয়া হয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের তরফে। শিব ঠাকুরের আপন দেশে, আইন কানুন সর্বনেশেই বটে!
আচ্ছা, উমা তো আমাদের ঘরেরই মেয়ে। সেই সুবাদে শিবও আমাদের ঘরেরই জামাই। ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রেখে আপনজন করে তুলতে পারলে শিল্পী তাঁর শিল্পদক্ষতাকে কেন সেই চোখে দেখার স্বাধীনতা পাবেন না? প্রশ্ন কিন্তু উঠছেই। শিল্প তো সীমান্ত, কাঁটাতার, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ সবকিছুর উর্ধ্বে। যাকে গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না। শিল্পীর মনের স্বাধীনতাতেই শৈল্পিক সত্ত্বার যথাযথ প্রকাশ পায়।
প্রসঙ্গত, শিল্পী তৌসিফ কিন্তু এর আগেও হিন্দু পুরাণের চরিত্রদের তাঁর কল্পনা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যানভাসে। তৌসিফের শিবকাহনের পর ‘ভারতমাতা’, ‘ন্যুড সরস্বতী’, ‘দ্রৌপদী’র মতো অতীতের বেশ কয়েকটি ‘বিতর্কিত’ চিত্রের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসছে। তবে, যামিনী রায় কিংবা বাংলার পটচিত্র, সবক্ষেত্রেই কিন্তু শিবকে ওই ‘নাদুসনুদুস’ চেহারায় দেখা গিয়েছে। তৌসিফের শিব এদের সকলের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। সেটাই যে শুধু আপত্তির কারণ, তা কিন্তু মনে করছে না বিদগ্ধ মহলের একটা বড় অংশ। বিশেষত দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই চিত্রশিল্পের সঙ্গে রাজনীতি এবং হিন্দুত্ববাদের যোগ যে বেশ প্রকট, সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট তাঁদের কাছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.