সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালক শুধু ভারতে কেন, গোটা পৃথিবীতেই বিরল। ক্যামেরা, ফ্রেম, আলো নিয়ে যেমন স্বচ্ছ্ব ছিল তাঁর ধারণা, তেমনই ছিল আবহসংগীতের বিষয়ে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য সংগীতের এক অনবদ্য মিশেল ঘটিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তাঁর ছবির আবহে যেমন রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ; তেমনই রয়েছেন বেটোফেন, মোৎসার্ট। জন্মশতবর্ষে মহারাজার আবহসংগীত নিয়ে কথা বললেন সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র। শুনলেন বিশাখা পাল।
নিজের ছবি নিয়ে বরাবরই খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, প্রায় প্রত্যেকেই সেকথা বলেন। বিশ্ববন্দিত এই চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল দেবজ্যোতি মিশ্রর। ‘ঘরে বাইরে’ ছবির জন্য ভায়োলিন বাজিয়েছিলেন তিনি। সত্যজিতের জন্মবার্ষিকীতে সেই গল্পই বললেন সংগীত পরিচালক। “ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল যেখানে বিমলা বেরিয়ে আসছে অন্দরমহল থেকে। ওই মুহূর্তের জন্য সত্যজিৎ রায় বেছেছিলেন ‘লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণে’। দীপক চৌধুরি সেতার বাজিয়েছিলেন। আমার মনে আছে, আমি, আরও অনেকে ভায়োলিনে ছিলাম। সবাইকে আলাদা আলাদা স্কোরশিট দেওয়া হয়েছিল। যে যার মতো প্র্যাকটিস করেছিলাম। ভায়োলিন ছাড়াও ছিল বাঁশি, চেলো, ভিয়োনা, সুরমণ্ডল, ভায়ব্রাফোন। আর যাঁকে না হলে এটা সম্ভব ছিল না, সেই বিশেষ মানুষ অলোক নাথ দে ছিলেন। সত্যজিতের সংগীতের সহযোগী ও অনন্য বাঁশি বাদক। রেকর্ডিং স্টুডিওয় যখন সব যন্ত্র থেকে সুর একসঙ্গে বেজে উঠল, সে এক স্মরণীয় মুহূ্র্ত। কোনওদিন ভুলব না আমি। রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে ইউরোপিয়ান অর্কেস্ট্রা মিশিয়ে এক অনবদ্য সৃষ্টি করেছিলেন মানিকবাবু। রেকর্ডিং ফ্লোরে তখন যে সুর উঠে এসেছিল, তার মধ্যে যেমন ‘লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’ ছিল, তেমনই ছিল বিষাদের সুর।”
আবহসংগীত নিয়ে বরাবরই কাটাছেঁড়া করতেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর কথায় বারবার উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গ। তিনি লিখেছিলেন, “ছবির ভাষা যেখানে সুষ্ঠুভাবে ব্যক্ত, সেখানেই সুরকারের দায়িত্ব যায় বেড়ে। কারণ ভাল ছবিকে নষ্ট করার একটি উপায় হল বেমানান আবহসংগীত।” তাই তাঁর ছবিতে যেমন হিন্দুস্থানী ক্লাসিকালের ছোঁয়া আছে, তেমনই আছে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব। পাশ্চাত্য সংগীত ও ইউরোপিয়ান অর্কেস্ট্রা বাংলা ছবিতে অসাধারণ ব্যবহার করেছিলেন তিনি। অনেক নামী সুরকার সত্যজিতের মিউজিক শুনে থ হয়ে যান আজও। একই কথা বললেন দেবজ্যোতি মিশ্রও। জানালেন, সত্যজিৎ রায় পাশ্চাত্য সংগীত শুনতেন। শ্রোতা হিসেবে তিনি যে অদ্বিতীয় ছিলেন, তাঁর আবহে সেই প্রমাণ মিলেছে বারবার। মিউজিক খুব ভাল বুঝতে পারতেন তিনি। অ্যানালিটিক্যালি সেগুলো ব্যবহারও করতেন ছবিতে। ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ বা ‘হীরক রাজার দেশে’র মধ্যে তার অসাধারণ প্রয়োগ রয়েছে। “আহা কী আনন্দ গানে তিনি মোৎসার্টের টোয়েন্টিফিফথ সিম্ফনির (mozart 25th symphony) কিছু সিগনেচার ব্যাবহার করেছেন। একই সঙ্গে জোহান সেবাস্টিয়ান বাখের ফিউগ (fugue), তাঁর মিউজিকের যে স্টাইল রয়েছে সেগুলি সেতার-সরোদ-সুরমণ্ডল ডাবল বেস দিয়ে, স্ট্রোক ইনস্ট্রুমেন্টস দিয়ে অপূর্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন। ছবির দৃশ্যের সঙ্গে সেই আবহ অসাধারণ মানিয়ে গিয়েছিল। এই গানটি যদি টোয়েন্টি ফিফথ সিম্ফনির সঙ্গে শোনা যায়, তবে ওই কেডনস (cadence) বোঝা যায়। ভারতে থেকেই তিনি এসব করতেন। এমনই ছিল তাঁর প্রতিভা।” বলেন দেবজ্যোতি মিশ্র।
সত্যজিতের আবহে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রবীন্দ্রসংগীত। রবি ঠাকুরের যে সিগনেটার তিনি ‘চারুলতা’ বা ‘ঘরে বাইরে’তে ব্যবহার করেছেন, সেখানে অসম্ভব মিউজিক্যাল প্রয়োগ রয়েছে। যদিও দেবজ্যোতি মিশ্রের মতে, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ বা ‘ফেলুদা থিম’-এ তিনি মিউজিককে অনেক স্মার্টলি ব্যবহার করেছেন। তাঁর মিউজিকের একটি দুর্দান্ত প্রয়োগ ‘হল্লা চলেছে যুদ্ধে’। গানে স্কেল চেঞ্জ থেকে শুরু করে অনেক কঠিন নোটসের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এমন দৃষ্টান্ত সচরাচর মেলে না। সুরের জায়গা থেকে সেটা ছিল এক নতুন রকম প্রয়োগ। দেবজ্যোতি বলেন, “এই গানটা শুনলে সত্যজিতের মিউজিকাল প্রতিভা কতখানি ছিল, তা বোঝা যায়। গানের যে অ্যারেঞ্জমেন্ট তিনি করতেন, তা ছিল অসাধারণ। তাঁর অন্য গানগুলির মধ্যে যেমন প্রয়োগের পারদর্শিতা লক্ষ্য করা যায়, তেমনই এই গান তাঁর প্রতিভার পরিচয় দেয়। আর এই গানের কম্পোজিশন…! ভাবলেই মাথা নত হয়ে যায়।”
সত্যজিতের আবহ ছিল ভীষণভাবে পাশ্চাত্য ঘেঁষা। বেটোফেন, মোৎসার্ট, বাখের মতো সংগীতজ্ঞের সংগীত তিনি এতটাই রপ্ত করেছিলেন, যে সেগুলি নিজের ছবির আবহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তাঁর অসুবিধা হয়নি। বরং জায়গা মতো এইসব সংগীতের প্রয়োগ শুনলে অবাক হতে হয়। দেবজ্যোতি বলেন, “যতদিন গেছে তাঁর চলচ্চিত্র আমার ভাল লাগেনি। কিন্তু তাঁর মিউজিকালিটি ক্রমাগত গ্লো করেছে। ওনার জলসাঘর ছবির ঝড়ের দৃশ্যে, যেখানে সব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, সেখানে সিবেলিয়থের একটি টেপকে তিনি রিভার্সে বাজিয়েছিলেন। ওফ… অসাধারণ! এগুলোই তাঁর মিউজিক্যাল প্রতিভার পরিচয় দেয়। তাঁর মিউজিক সেন্স যে সাংঘাতিক ছিল, এগুলোই তার প্রমাণ। অত্যন্ত স্মার্ট ছিল তাঁর মিউজিক। সেই সত্যজিৎই আবার ‘পথের পাঁচালী’তে তারসানাই ব্যবহার করেন। অথচ, তারপর, আর কোনওদিন তিনি এর ব্যবহার করেনি। দুর্গার মৃত্যুতে দক্ষিণামোহন ঠাকুরের তারসানাই যে বিলাপ তৈরি করবে, তা বুঝেছিলেন সত্যজিৎ। হয়েছিলও তাই। রবি শঙ্করের মিউজিক হলেও সত্যজিতের প্রয়োগ ছিল অদ্বিতীয়। ওই একবারই ঋত্বিকীয় মেলোড্রামাটিকভাবে বেজেছিল তারসানাই। এই প্রথম এবং এই শেষ। দুর্গার মৃত্যুর পর যে শূন্যতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার জন্য ওই জায়গায় তারসানাইয়ের অতিরিক্ততার প্রয়োজন ছিল। মিউজিক নিয়ে অনবদ্য জ্ঞান না থাকলে এসব বোঝা সম্ভব নয়।”
প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য সংগীতের এক অনবদ্য মিশেল ঘটিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘চারুলতা’, ‘ঘরে বাইরে’; এমনকী ফেলুদার থিমেও তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আবহ নিয়ে প্রতিনিয়ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি। তাঁর লেখাতেই সেকথা স্পষ্ট। আবহসংগীত নিয়ে লিখতে গিয়ে সত্যজিৎ লিখেছিলেন, “…যেখানে জাতীয় জীবনে, মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদে, কথাবার্তায়, বাড়িঘরদোরের চেহারার কোনও স্পষ্ট চরিত্র নেই- সবই যেখানে পাঁচমেশালি খিচুড়ি, সেদেশের পটভূমিকায় আধুনিক ছবির আবহসংগীত রচনা এক দুরূহ ব্যাপার। অথচ এ চ্যালেঞ্জ এড়ানো চলে না।” এমনই ছিলেন সত্যজিৎ। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি চলচ্চিত্র সংগীতেরও একটি বিশেষ অধ্যায় হয়ে থাকবেন তিনি। ‘মহারাজা… তোমারে সেলাম’।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.