চারুবাক: ‘মারীচ সংবাদ’ এবং ‘জগন্নাথ’ – দু’টি নাটকই আমার প্রথম দেখা অ্যাকাডেমির মঞ্চে। সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় শোয়ে। অধুনালুপ্ত তৎকালীন এক জনপ্রিয় দৈনিকে থাকার সুবাদে। যতদূর মনে পড়ে লিখেওছিলাম দু’টি নাটক নিয়ে। সেই নাটকই আবার মুগ্ধ করল চেতনা নাট্যগোষ্ঠীর ৫০ বছরের উদযাপনের উৎসবে।
আমেরিকান ডেমোক্রেসির প্রকৃত চেহারা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পাশাপাশি মারীচের জীবনের সংকটের সঙ্গে ঈশ্বর নামে এক অতিদরিদ্র লেঠেলের জমিদারের চাপের কাছে নতিস্বীকার একাকার হয়ে মঞ্চে এক নতুন আবহের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলা নাটকের ইতিহাসে তা অমলিন। জনপ্রিয়তায় চেতনা (Chetana Theatre Group) নাট্যদল ওই একটি প্রযোজনা দিয়েই একেবারে প্রথম সারিতে চলে আসে। শম্ভু মিত্র – উৎপল দত্ত – অজিতেশের পাশাপাশি তরুণ নাট্যকার অরুণ মুখোপাধ্যায় তাঁর কলম ও মঞ্চায়নে নিয়ে এলেন এক তাজা ভাবনা। আর নিজে যখন আত্মজ নীলকে সঙ্গী করে গাইতে ঢুকলেন, তখন হাততালি ও চিৎকারে মুখর গোটা মধুসূদন মঞ্চ।
অবশ্য শুরু থেকেই হলের বাইরে বেশ উন্মাদনা ছিল। অনেকদিন বাদে আবার প্রায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠা ‘মারীচ সংবাদ’-এর মঞ্চায়ন ঘটছে – সেটা নিয়েই প্রবীণ-নবীন সকলের মধ্যেই রয়েছে উৎসাহ। আর যখন মঞ্চে দেবশংকর হালদার তাঁর জাদুকাঠির খেল দেখাতে একে একে মঞ্চে অনির্বাণ চক্রবর্তী (মারীচ), নীল মুখোপাধ্যায় (কথক ঠাকুর), অনির্বাণ ভট্টাচার্য (গ্রেগরি), শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় (রাবণ), বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় (আমেরিকান সেনেটর), সুপ্রিয় দত্ত (প্রেসিডেন্ট প্রতিনিধি উইলিয়ামস) এবং মেরিবাবার চরিত্রে একেবারে নতুন সাজপোশাকে খোদ সুমন মুখোপাধ্যায়কে ডেকে আনেন তখনই তাক লেগে যায়। তবে একেবারে শেষ মহাকবি বাল্মীকির চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের আবির্ভাব এবং তাঁর সাবলীল স্টাইলে কমিক অভিনয়ই যেন সবচেয়ে বেশি হাততালি পেল।
পরিচালক সেই পুরনো সময়ের নির্দেশনা থেকে খুব একটা সরে আসেননি, শুধুমাত্র একটি সংলাপ যোগ করেছেন মনে হল। নইলে নিপাট, নিটোল এবং টানটান পরিবেশনা। এতজন ‘স্টার’ মঞ্চাভিনেতা নিয়ে কোথাও এতটুকু বেতাল হয়নি অরুণবাবুর নির্দেশনা। সকলেই যেন নিবিষ্ট চিত্তে পুরনো নাটকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাই জানালেন। প্রত্যেকেই নিজেদের অন্তর দিয়ে ‘মারীচ সংবাদ’-এর নতুন প্রতিমায় প্রাণের সঞ্চার করলেন। দুই অনির্বাণ তো বটেই, দেবশংকর হালদার, সুপ্রিয় দত্ত, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজন (নীল) মুখোপাধ্যায়, কেউ কাউকে ছাপিয়ে যেতে চাননি। বরং নাটকটি দুর্দান্ত এক সমবেত প্রয়াস হয়ে রইল।
বেশ কিছু বছর আগে ফ্রিতজ বেনেভিটজের পরিচালনায় শম্ভু মিত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে কলকাতার অভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে তৈরি ‘গ্যালিলিও’ নাটকের উপস্থাপনার সময়ও এমনটা ঘটেছিল। খেয়াল করলাম নতুনএই প্রযোজনায় আবহ রচনায় কিছু সংযোজন হয়েছে, মঞ্চ ভাবনাও বদলেছে। তবে সবটাই ঘটেছে যান্ত্রিক উন্নতির কারণে, কোথাও নাটকের মূল সুর চলন ও বক্তব্যকে ক্ষুন্ন করা হয়নি। মেরিবাবা গানটির সঙ্গে শুভদীপ গুহর অর্কেস্ট্রাশন বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। যেমন সুমনের সুমনের ছোট ছোট সাবটল অভিনয় ও নাট্যক্রিয়া গানটিকে আরও আবেদনময়ী করেছে।
হ্যাঁ, প্রয়াত বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর অসাধারণ পরিবেশনার কথা মনে রেখেই প্রশ্ন – নতুন এই প্রযোজনা আরও দু-চারবার কি মঞ্চায়ন করা যায় না? ‘চেতনা’র দ্বিতীয় সফল নাটক ‘জগন্নাথ’ অবশ্য মঞ্চস্থ হয়েছে দলের প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের নিয়েই। কোনও আমন্ত্রিত শিল্পী ছিলেন না। জগন্নাথের চরিত্রে সুজন, এবং নন্দর চরিত্রে সুমন। প্রথম মঞ্চায়নে পরিচালক অরুণ মুখোপাধ্যায় নিজেই ছিলেন নাম ভূমিকায়। তাঁর অভিনয়ে ছিল মাটির ছোঁয়া, তাঁর ক্ষীণকায় শরীরটাই ছিল চরিত্রের পক্ষে প্রধান মূলধন। সুজনের চেহারায় সেই খামতি তিনি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শরীরী অভিনয় দিয়ে। হ্যাঁ, তিনি পিতার জুতোয় পা গলিয়েও তাঁর সম্মান বজায় রেখেছেন।
কেন জানি না – নাটকের প্রায় শেষ দৃশ্যে যেখানে জগন্নাথ রাগ ও আনন্দ মিশিয়ে বলছে, “পারবে পারবে তোদের নন্দ, অন্যলোকের ছেলের বাপ হতে…!” এইখানটায় অরুণবাবুর অভিনয় দর্শকের বুকে একটা মোচড় দিত। এই প্রযোজনাটিতেও ৪৫/৪৬ বছরের কোনও দাগ লাগেনি। এখনও সমভাবে সাম্প্রতিক। যদিও অরুণ মুখোপাধ্যায় বললেন, “আমি চাই ‘মারীচ সংবাদ’ বন্ধ হোক, বন্ধ হোক চাপ দিয়ে বশ্যতা আদায়ের কৌশল।” কিন্তু সারা বিশ্বে এখনও গণতন্ত্রের নামে বৃহৎ দেশগুলোর আগ্রাসী মনোভাবের বদল তো হয়ইনি বরং আরও চাপ বাড়ছে। এই দু’টি নাটকের পুনর্মঞ্চায়ন এবং সেখানে ‘হাউসফুল’ দর্শক বুঝিয়ে দিল বাংলা নাটক এখনও জীবন্ত, দর্শকও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.