ভাস্কর মুখোপাধ্যায়, বোলপুর: খোল,করতাল,খঞ্জনি – কিছুই নেই। আখড়ার স্টেজে গিটার বাজাচ্ছেন দুই যুবক। পিছনে সিন্থেসাইজারে সুর তুলছেন আরেকজন। আর এই বাজনার তালে তালেই লীলা কীর্তন গান গেয়ে চলেছেন এক যুবতী। মন্ত্রমুগ্ধের মত তা শুনছেন আখড়ায় জমায়েত করা পুণ্যার্থীরা। রাঙামাটির দেশে জয়দেব-কেন্দুলির মেলায় এভাবেই মিলেমিশে গিয়েছে ঐতিহ্যের বাদ্যির সঙ্গে আধুনিক বাজনা। প্রাচীন এই লোকসংস্কৃতি উৎসবে শামিল হওয়া মানুষজনও দিব্যি তাল মিলিয়ে নিয়েছেন একটুকরো বদলের সঙ্গে।
বাউল গানের পাশাপাশি কীর্তনগান জয়দেব মেলার অন্যতম আর্কষণ। কীর্তনীয়াদের কাছে এই মেলা এক অন্য ভাবনা, অন্য কিছু প্রাপ্তির আশা। প্রতি বছরের মত এবছরও অধিকাংশ আখড়াগুলিতে কীর্তন গান চলছে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কীর্তনীয়ারা ভিড় জমিয়েছেন এই মেলায়। তাঁদের মতে, জয়দেব মেলা শ্রোতা ও ভক্তের মহামিলন ক্ষেত্র। কীর্তনের জনপ্রিয়তা নিয়ে ইদানিং প্রশ্ন উঠলেও, জয়দেব-কেন্দুলি মেলাই সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়, আকর্ষণে এতটুকুও ভাটা পড়েনি। নতুন প্রজন্মের কীর্তন শিল্পীরা যুগোপযোগীভাবে কীর্তন গানকে নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করছেন। তারই মধ্যে ঢুকে পড়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদের ঘরানাও।
সংস্কৃত সাহিত্যের রসাস্বাদন যাঁরা সেভাবে করতে পারেননি, তাঁদের কাছে নতুন আঙ্গিকের কীর্তন অনেকটা সহজভাবে গৃহীত হচ্ছে। মূলত খোল,করতাল,হারমোনিয়াম,বাঁশি,খঞ্জনি সহযোগে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে কীর্তন। কিন্তু ওই ঐতিহ্যের বাদ্যযন্ত্রের বদলে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গিটার,সিন্থেসাইজার। তাতেও দিব্যি খুলছে এই আঙ্গিকটি। একটা সময় কীর্তন পরিবেশনে পুরুষ কন্ঠের প্রাধান্য ছিল। তবে দিনদিন মহিলা শিল্পীদের প্রাধান্য বাড়ছে। আধুনিক কীর্তন সম্প্রদায় ব্যবসায়িক কারণে সিডির মাধ্যমে কীর্তনকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এর ফলে জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।
জয়দেবের মেলার কীর্তনের আখড়ায় গিয়ে দেখা গেল, খড় পেতে বসার জায়গা করা হয়েছে শ্রোতাদের। বড় বড় সাউন্ড সিস্টেম বসানো হয়েছে। গিটার, সিন্থেসাইজারের সুরে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বর্ণনা করে চলেছেন এক গায়িকা। কীর্তন শিল্পী রাধা মা বলেন, ”গানের ব্যবহৃত যন্ত্রের হয়ত পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কীর্তনের সুরে কোনও বদল ঘটেনি। আমরা চেষ্টা করেছি শ্রোতাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় ভাবে এই গান পরিবেশন করতে।” নদিয়া থেকে জয়দেবের মেলায় আসা পুণ্যার্থী সাগর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ”খোল-করতাল সহযোগে কীর্তন অনেক বেশি শ্রুতিমধুর। তবে এখন এই পরিবর্তন মানুষ মেনে নিয়েছেন।” খোল-করতাল-খঞ্জনি নাকি গিটার-সিন্থেসাইজার, কোন বাদ্যযন্ত্রে কীর্তন কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিছে গিয়া, তা বিতর্কের বিষয় হতেই পারে। তবে কেন্দুলি-জয়দেবের মেলা এখনও জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছে স্রেফ কীর্তনের সুরেই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.