সরোজ দরবার: একজন কিংবদন্তি। অপরজন এই সময়ের অন্যতম সচেতন শিল্পী। একজন বলেন, ওর কাজ দেখলে চোখ পবিত্র হয়ে যায়। অপরজন বলেন, ওঁর মতো মানুষের সঙ্গে যে কাজ করছি, সেটাই বড়ো সৌভাগ্য। কবীর সুমন ও ভবতোষ সুতার। বয়সের ব্যবধানকে সরিয়ে দুই শিল্পী একে অপরের জন্য তুলে রেখেছেন অপরিসীম শ্রদ্ধা। মেধা ও মননের প্রতি সেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ই বোধহয় তাঁদের ভাবনার জগতে খুব কাছাকাছি এনেছে। তৈরি হয়েছে যুগলবন্দি। এই পুজোতেও তা অটুট। দুই শিল্পীর মেলবন্ধনের থিম এবার ‘জন্ম’।
মানুষের প্রকৃত জন্ম মুহূর্ত কবে? খাতায় কলমে একটি দিন বা সময় থাকে বটে। কিন্তু সেটাই কি জন্মের প্রথম শুভক্ষণ! খ্যাতনামা দর্শনের অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী তাঁর লেখায় জানিয়েছিলেন, ‘আমার জন্ম’ এহেন শব্দবন্ধে ‘আমার’ শব্দটি নিয়ে বেজায় বিপত্তি। কেন-না ‘আমার কাজ’ বললে যেমন কোনও এক ‘আমি’র অস্তিত্ব থাকে, অনুরূপভাবে জন্মের আগে কি ‘আমি’ বলে কেউ থাকে? আর ‘আমি’ যদি নাই-ই থাকে তাহলে ‘আমার জন্ম’ বলাই বা যায় কী করে! তিনি জানান, ‘গর্ভোপনিষৎ’ নামক এক প্রাচীন গ্রন্থে বিধৃত যে, শুক্রশোণিতের সংপ্রয়োগের ফলে যে কলিল উৎপন্ন হয়, তা একটু একটু করে বড় হতে হতে, সপ্তম মাস নাগাদ জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। অষ্টম মাসে তা মায়ের শরীর থেকে খাদ্য আহরণ করতে পারে। নবম মাসে তার পুর্বজন্মের স্মৃতি ফেরে। সে ব্যাকুল হয়। ভূমিষ্ট হওয়ার তাগিদ দেখা দেয় তার ভিতর। অবশ্য ভূমিষ্ট হওয়া মাত্র ‘বৈষ্ণবী বায়ু’র স্পর্শে বিগত স্মৃতি সব ভুলে যায়। এ-কেবল প্রাচীন গ্রন্থের কথা নয়। অধ্যাপক চক্রবর্তী জানান, এ-বিষয়ে আধুনিক পড়াশোনাও আমাদের জানাচ্ছে যে, সদ্যোজাত শিশু গর্ভস্থ অবস্থা থেকেই নিজের আত্মসত্তা অনুভব করতে পারে। ফলে শারীরিকভাবে আমাদের প্রকৃত জন্মমুহূর্ত ঠিক কখন, তা মীমাংসার বিষয়ই বটে। আর এখান থেকেই শুরু শিল্পী ভবতোষ সুতারের যাত্রা।
ভবতোষের পুজোর থিম ‘জন্ম’। কিন্তু নেহাতই তা চমকপ্রদ পুজোর থিম নয়। বরং এক গভীর দার্শনিক পথ ধরেই বৌদ্ধিক মীমাংসার দিকে হেঁটেছেন শিল্পী। এ-জন্ম আক্ষরিক অর্থেই ‘আমার জন্ম’। কারণ, এখানে ‘আমি’ অস্তিত্বশীল এবং তা সতত পরিবর্তনশীল বলেই এই জন্ম সম্ভব। এখানে আমিই আমার জন্ম বাস্তব করে তুলছি। শিল্পীর কথায়, ‘এই যে শারীরিক জন্ম, তা তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু মানুষ একজন্মেই তার পুনর্জন্ম ঘটাতে পারে।’ মনে পড়ে যায়, রবি ঠাকুরকে – ‘এক জনমে ঘটালে মোর জনম জনমান্তর’। যেন সেই প্রতিধ্বনি করেই ভবতোষ বলেন, ‘চেতনায়, বোধে একজন মানুষ আবার জন্ম নিতে পারেন। সেই বোধ মুক্তচিন্তার। যা কিছু অটল, অচল, জঙ্গম- তাই-ই তো মৃত। অথচ নিজেকে ভাঙতে পারলেই নতুন জন্ম সম্ভব। নিজেকে ভেঙে নতুন করে আবিষ্কার করাই নতুন জন্ম। আর সে-জন্ম মানুষের নিজের হাতে। নিজের অনুশীলনে ও বৌদ্ধিক প্রসারতায়।’ তবে কি পুজোর কলকাতাতে বসেই শিল্পী ভবতোষ সার্ত্রোর ব্যক্তির ধারণাকে নতুন করে খুঁজে দেখতে চাইছেন? চাইছেন সেই পরিবর্তনশীল ব্যক্তির পুষ্টিতেই সামগ্রিক চেতনার কাছে পৌঁছাতে? হয়তো বা। সে সাক্ষ্য থাকবে তাঁর শিল্পকর্মে, অনুধাবনের দায় দর্শকের অবশ্যই।
এই নিজস্ব জন্মের কথাই গানে গানে বলছেন নাগরিক কবিয়াল,‘…মানুষ না হয়ে হতাম মাটির কলস যদি/ ভাসতাম একা বোধের নীরব ধ্বনিতে আমি/ জন্ম দিয়েছ তোমার গর্ভে তোমাতে নামি/ তোমারই জন্য মাটির দুর্গে বাঁচার লড়াই/ বোধের জন্ম মগজে, এটাই আমার বড়াই।’ মহাকালের জীবনপ্রবাহকে যেন এ গানের সুরে ধরে রেখেছেন তিনি। এই নিয়ে তিনবার তাঁরা একসঙ্গে পুজোর কাজ করছেন। ভবতোষ বলেন, “সুমনদার মতো মানুষ যে কাজ করতে রাজি হয়েছেন, তা আমার কাছে প্রাপ্তি। আর গত দু-বারের মতো এবারেও সবাই নিশ্চয়ই বুঝবেন যে, এ কেবল পুজোর থিম সং নয়। এ স্বয়ংসম্পূর্ণ সংগীত, যা মানুষকে নতুন ভাবনায় জারিত করবে। ঠেলে দেবে দর্শনের পথে।”
শব্দ-সুর-ধ্বনি-ভাস্কর্য সব মিলিয়েই এক নতুন জন্মের বার্তা দেবেন দুই শিল্পী, নাকতলা উদয়নে। পুজোর উৎসবে শামিল মানুষ যদি সংস্কৃতির সেই উৎসবটিকে চিনে নেন, তবেই বোধহয় এক জন্মে সম্ভব হবে জন্মান্তর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.