বিশ্বদীপ দে: একটা আড়াইশো বছরের বাজার। সকালবেলা হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে ভিড়াক্কার। আবার দুপুরের পর তা শুনশান। এমনই এক স্থানে কিনা ছবির প্রদর্শনী! ‘বাজার’ শব্দটির মধ্যে জল-কাদা-মেছো গন্ধে থইথই একটা ব্যাপার রয়েছে। আবার ছবির প্রদর্শনী মানেই আর্ট গ্যালারির কনকনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আভিজাত্য। এই দুই ধারণাই ভেঙে চুরমার হাওড়ার কালীবাবুর বাজারে। শিল্পী হিরণ মিত্রর ৩১টি নতুন ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে এখানেই। কখনও উপরের টিনের শেড দিয়ে দুদ্দাড়িয়ে দৌড়ে যাচ্ছে কুকুর। হ্যালোজেনের আলোয় চকচক করছে নর্দমার জল। দ্রুতবেগে স্থান বদলে নিচ্ছে ইঁদুর। সেখানেই এই আয়োজন। ৯ জুলাই শুরু হয়ে ১১ জুলাই শেষ। সকাল ৯টা থেকে ১১টা। আবার বিকেল ৬টা থেকে রাত ৯টা। শুধু ছবি নয়, সন্ধে গড়াতে না গড়াতেই কবিতা-গান-নাচ-নাটক-আড্ডা!
এবারই প্রথম নয়। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি, দুদিনের প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল এখানে। মাস সাতেকের মধ্যে ফের এমন পরিকল্পনা। হঠাৎ কেন মাছের বাজারে ছবির প্রদর্শনী? হিরণ মিত্র বললেন, ”ছবি যখন গ্যালারিতে থাকে, আমার মনে হয় মর্গে মড়া ঝুলছে। তাই জ্যান্ত মাছের বাজারে আমি জ্যান্ত ছবি ঝোলানোর চেষ্টা করেছি।” বাকি কবি-শিল্পীদের প্রতিক্রিয়া কী? একথা শুনে ঈষৎ থমকে তিনি জানাচ্ছেন, ”কেউ কোনও মন্তব্য করেননি এখনও। আসলে শিল্পীরা আসেননিই। তাই মন্তব্যও করেননি। আর কিছু কবি আছেন, যাঁরা নিজেকে খুব বিখ্যাত বলে মনে করেন। তাঁরা খুব হতাশ। এই হতাশ হওয়াটা আমার কাছে খুব আনন্দের। আমি তো কিছু লোককে হতাশ করতেই চাইছি। এই যে একটা স্থিরকৃত ধারণা সেটাকে ভাঙতেই চাইছি।”
জোনাকি নাট্য গোষ্ঠীর আয়োজনে কালীবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সহযোগিতায় এমন এক প্রদর্শনীতে ঢুকে পড়লে সত্যিই একটা ধাক্কা লাগবে। সন্ধের হাওয়ায় দুলছে ছবি। নিচে বন্ধ বাজারের থমকে থাকা দৃশ্য। আর বাজারের এককোণে তখন কেউ পাঠ করছেন নাটক ‘অয়দিপাউস’। আরও একটু দূরে চারজন দল বেঁধে তাস খেলছেন। খেলতে খেলতেই আনমনা হয়ে শুনে নিচ্ছেন মাইকে গমগম করে কী চলছে।
চিত্রশিল্পী বিশ্বজিৎ দাস বলছিলেন, ”হিরণদা চেয়েছিলেন ধাবায় একটা প্রদর্শনী করবেন। পরে অন্য কোনও স্পেস খোঁজা হচ্ছিল। আচমকাই আমার মাথায় আসে এই বাজারের কথা। আমি ভিডিও কল করে হিরণদাকে বললাম, দেখো চলবে কিনা। হিরণদার খুব পছন্দ হয়ে গেল। ব্যাস। গত শীতে হয়েছিল প্রথম প্রদর্শনী। সেবার হয়েছিল দুদিন। এবারের আয়োজন তিনদিনের জন্য।” বাজারকে ঘিরে থাকা সাধারণ মানুষ, তাঁদের কী প্রতিক্রিয়া? বিশ্বজিৎ জানাচ্ছেন, ”তাঁরা আসছেন। দেখছেন। উৎসাহও পাচ্ছেন। এখানে একটা ছেলে মাছ বিক্রি করে, নাম মুনু। ও এসব দেখে বলছে, আমিও আঁকব। আবার এক বিক্রেতার বাচ্চা ছেলেটা, সেও গিয়ে হিরণদাকে বলছে, দাদু আমিও আঁকব।”
হিরণ মিত্রর এই একক প্রদর্শনীর নাম ‘আর্ট ইন এভরিওয়ান’। প্রত্যেকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিল্পের ‘স্পার্ক’কে জাগিয়ে তোলাই যেন অভীষ্ট। দিনের বেলায় এই বাজার গমগম করে। সেই সময় মাছের পসরার উপরে কালো লাল রেখায় টানা হিরণ মিত্রর নতুন ছবি হাওয়ায় কাঁপে। আবার বেলা গড়ালে নিঝুম বাজারেও সেই ছবি এক অন্য আবেদন তৈরি করছে যেন। যেন এক অনির্দেশ্য শিল্পরূপ নিজের মতো করে জায়গা করে নিচ্ছে ঘাম-রক্তের পৃথিবীতে। যে আদিম মানুষ আলতামিরার গুহাচিত্র এঁকেছিলেন, তাঁর নাম কেউ জানতে পারেনি। কেবল থেকে গিয়েছে সেই বাইসনের উদ্যত ভঙ্গি। হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর শাশ্বত এক শিল্পচেতনাই বুঝি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে কালীবাবুর সুপ্রাচীন মাছের বাজারে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.