বিশ্বদীপ দে: অনেকেই খুঁজছে বইটা। তাদের মতে, এটা নেই বলা হলেও আসলে আছে। কিন্তু ‘অবিশ্বাসী’দের মত হল, এটা আছে বলে মনে হলেও কোত্থাও নেই। তাই তাকে খুঁজে চলারও অন্ত নেই। শুনতে যতই ধাঁধার মতো মনে হোক, অভিশপ্ত ‘নেক্রোনমিকন’ মহাগ্রন্থটি এমনই কুয়াশা ছড়িয়ে রেখেছে বিশ্বজুড়ে। প্রায় একশো বছর হতে চলল, বহু মানুষই বুক ফাটিয়ে বলে চলেছেন, ”আছে, আছে, সব আছে, সব সত্যি”! কিন্তু আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বইটি। পাওয়ার কথাও নয় বোধহয়। এই বই যে স্বপ্নে পেয়েছিলেন এইচপি লাভক্র্যাফট (HP Lovecraft)। সর্বকালের অন্যতম সেরা মার্কিন এই লেখক সেখান থেকেই একে আমদানি করেছিলেন তাঁর লেখায়। চর্মচক্ষে এই বইটি কেউই দেখেননি। কিন্তু সত্য়িই কি তাই?
মনে হতেই পারে কেন বহু মানুষ খুঁজছেন বইটি? কী আছে তাতে? একটু খোলসা করা যাক। আসলে এ এমন এক বই, যেখানে মৃত শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল বলা রয়েছে। আবার পৃথিবীর দুর্গম কোণে ঘুমিয়ে পড়া কবেকার অতিকায় সব মহাদানবদের জাগিয়ে তোলার মন্ত্রও সেখানে আছে। আছে এমনই আরও সব অতিপ্রাকৃত কৃতকৌশল, যা একবার জেনে ফেললে সব কিছুই চলে আসবে হাতের মুঠোয়। বইটি বাঁধানো মানুষের চামড়ায়। পাতাগুলিতে যে অক্ষরসজ্জা, তা রক্তে লিখিত!
হ্যাঁ, আপনিও কিন্তু নেক্রোনমিকনের কথা জানেন। বিখ্যাত হলিউডি ভূতূড়ে ছবি ‘ইভিল ডেড’ (Evil Dead) দেখেছেন নিশ্চয়ই। পরে যার আরও বহু সিক্যুয়েলও মুক্তি পেয়েছে। সেই ছবিতে দেখা মিলেছিল ‘বুক অফ দ্য ডেড’-এর। যে বইয়ের বিভিন্ন অংশ পড়তে গিয়ে অজান্তেই অন্ধকার দুনিয়ার ভয়ংকর শক্তিদের জাগিয়ে ফেলেছিল কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণী। রাতারাতি তাদের জীবন কেমন নরক গুলজার হয়ে উঠেছিল তা সকলেই জানেন। যাই হোক, এই বইটিই আসলে নেক্রোনমিকন (Necronomicon)। যা নাকি পুরোটা একসঙ্গে নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর বিভিন্ন টুকরো। সব ক’টি টুকরো একসঙ্গে জুড়তে পারলে যে বিপুল শক্তির অধিকারী হওয়া যাবে, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেই কাজটা কঠিন। তবে আপনি যদি এর একটি খণ্ডও পান, সেটাই অনেক। কিন্তু… কোথায় আছে সেই সব খণ্ড? পৃথিবীর কোন অন্ধকার কুঠুরিতে?
গত শতকের তিনের দশক থেকেই শোনা যেতে থাকে ‘নেক্রোনমিকন’ কোনও কাল্পনিক বই নয়। সত্য়ি সত্য়ি রয়েছে এই মহাগ্রন্থ। এর কয়েক বছর আগে ১৯২২ সালে লাভক্র্যাফট লিখেছিলেন ‘দ্য হাউন্ড’। থরথরিয়ে কেঁপে ওঠার মতো গল্প। বছর দুয়েক পরে ১৯২৪ সালে প্রথমবার ছাপার অক্ষরে উল্লিখিত হয় ‘নেক্রোনমিকনে’র কথা। সেখানে জানানো হয়েছিল ‘ম্যাড আরব’ ওরফে আবদুল আলহাজরেদ। তাঁর কথা কিন্তু ‘দ্য নেমলেস সিটি’ নামের আরেক আশ্চর্য গল্পে আগেই লিখেছিলেন লাভক্র্যাফট। সেই শুরু। এরপর লেখক নিজেই সেই মহাগ্রন্থের এক কল্পিত ইতিহাস লেখেন। আর তাতেই বইটি ঘিরে কুয়াশা ঘনাতে থাকে। বহু মানুষই ক্রমে বিশ্বাস করে ফেলেন, নিছক কল্পনা নয়। সত্য়িই আছে ‘নেক্রোনমিকন’।
কিন্তু লাভক্র্যাফট কেন এমন একটি বইয়ের কল্পনা করেছিলেন? কিংবদন্তি মার্কিন সাহিত্যিক নিজে দাবি করেছিলেন, স্বপ্নেই তাঁর মনের ভিতরে ভেসে উঠেছিল বইটির নাম। যদিও অনেকের দাবি, এই বইয়ের আইডিয়া সেই অর্থে লাভক্র্যাফটের মৌলিক নয়। তিনি রবার্ট ডবলিউ চেম্বার্সের গল্প সংকলন ‘দ্য কিং ইন ইয়েলো’ থেকে নাকি রহস্যময় এমন একটি বইয়ের ধারণা পেয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু নেক্রোনমিকন ও লাভক্র্যাফট প্রায় একসঙ্গেই উচ্চারিত হয় পৃথিবী জুড়ে। দুটি নাম ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হয়ে রয়েছে।
তবে বইটা যে আছে, এই ধারণা জমাট বাঁধে ‘সাইমন নেক্রোনমিকন’ বা ওই ধরনের আরও বেশ কিছু বই থেকে। যেগুলিকে দাবি করা হয়েছিল ‘সত্যি’ নেক্রোনমিকন বলে। সেখানে নাকি ব্যাবিলনীয় ও সুমেরীয় ‘টেক্সটে’ লেখা আছে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার মন্ত্র! এমনকী, হিটলারের উত্থানের সময় বলা হতে থাকে নাৎসি বাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রতিপত্তির মূলে রয়েছে ‘নেক্রোনমিকন’! ততদিনে অকালমৃত্যু হয়েছে লাভক্র্যাফটের। কিন্তু না থেকেও তিনি প্রবল ভাবে থেকে গেলেন। অসাধারণ সাহিত্যসৃষ্টি ও রহস্যের কুয়াশামাখা জীবনের যুগলবন্দিতে। যার কেন্দ্রবিন্দুই হয়তো এই বই।
এই মহাবিশ্ব রহস্যময়। সেই রহস্যকে বিজ্ঞান নিজের মতো করে সমাধান করে চলেছে। কিন্তু এরই সমান্তরালে রয়েছে অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস। যা বলে, এই মহাজগতের রহস্য এখনও বিজ্ঞানের আয়ত্তে আসেনি। একমাত্র অতিপ্রাকৃতের চর্চাই দিতে পারে সেই মহাজ্ঞান। আর সেই জ্ঞানেরই আকরগ্রন্থ হল ‘নেক্রোনমিকন’। এখানে রয়েছে এমন সব আদিম দেবতাদের উল্লেখ, যারা একবার জেগে উঠলে বিশ্ব সংসার রসাতলে যাবে। যাদের কাছে এই সভ্যতা নিছকই বুদবুদের মতো। স্বাভাবিক ভাবেই এমন বই সকলেই হাতের মুঠোয় পেতে চাইবে। বিশেষ করে যারা আচমকা ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে। সারা পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা তো কম নয়। তাদের সকলের মুখে মুখে গোটা দুনিয়া জুড়ে ‘নেক্রোনমিকন’ ও তার অলৌকিক বিভার কাহিনি ছড়িয়ে গিয়েছে।
সময় গড়িয়েছে। লাভক্র্যাফটের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে প্রায় নয় দশক। কিন্তু তাঁর কলমের ডগা থেকে সৃষ্টি হওয়া এক মহাগ্রন্থের জলছাপ এভাবেই তৈরি করে রেখেছে আলোড়ন। আসলে যেটা নেই, সেটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি মায়া তৈরি করে। সে মায়াকে কাটানো যায় না। সাধারণ মানুষের চোখে ব্রহ্মাণ্ডের অসীম বিস্তার ও জগতের লীলা এমনই অপার, তারা তাকে বুঝে উঠতে পারে না। তাদের কাছে এই ধরনের মহাগ্রন্থের ধারণা তাই সহজেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এর বাইরেও রয়েছে এক দল, যাঁরা কল্পনারসে মনকে আর্দ্র করে রাখেন। তাঁরা ভাবতে ভালবাসেন, পৃথিবীর দুর্গমতম কোনও কোণে, সে নির্জন দ্বীপ হতে পারে অথবা বরফে ঢাকা মেরুদেশ কিংবা মরুভূমির বালিময় সমুদ্রের কোনও প্রান্তে, লুকনো রয়েছে ‘নেক্রোনমিকন’। এই কল্পনার যে রোমাঞ্চ, তাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন তাঁরা। এই ভাবেই ‘জীবন্ত’ হয়ে রয়ে গিয়েছে নেক্রোনমিকন। আজও। যা টিকে থাকবে আগামিদিনেও। রহস্যের আবেদন যে কখনও ফুরোয় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.