বিশ্বদীপ দে: বাঙালি আর মাছ (Fish)। পাশাপাশি এই দু’টি শব্দ বসিয়ে দিলে কী দাঁড়ায়? সেটাও বলতে হবে? গোটা ভারত মাছ বা ‘মছলি’ বলতে যে প্রাণীটিকে বোঝে তা যে বাঙালি নামক জাতিটির আত্মায় একেবারে যাকে বলে ট্যাটু করা সে তো আসমুদ্র হিমাচল জানে। বুঝতেই পারছেন, এই মুহূর্তে এই চিরকালীন কথাগুলির পুনরাবৃত্তির পিছনে রয়েছেন পরেশ রাওয়াল (Paresh Rawal)। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মতো এই প্রদেশেও তিনি ভালই জনপ্রিয়। কিন্তু তা বলে বাঙালিকে মাছের খোঁটা দিয়ে বসবেন প্রবীণ অভিনেতা? রাজনীতি, বিতর্ক এসবে আমরা ঢুকব না। কেবল এই লেখায় একবার বুঝে নিতে চাইব কেন বাঙালিকে মাছ নিয়ে বলতেই এমন গনগনে হয়ে উঠল সাম্প্রতিক এই বিতর্কের আঁচ? কেনই বা দেশের অন্যান্য প্রদেশে মাছ খাওয়ার জন্য বিদ্রুপেরও শিকার হতে হয় বাঙালিকে?
আসলে নদীমাতৃক বঙ্গদেশের অধিবাসীদের (Bengalee) ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ এমনি এমনি বলা হয় না। এটা কেবল খাদ্যাভ্যাস নয়। সাহিত্য থেকে ঐতিহ্য, শুভাশুভের যোগ, মাছের সঙ্গে বাঙালি একেবারে লতায় পাতায় জড়িয়ে। আমাদের চিরচেনা ভূতপ্রেতেও রয়ে গিয়েছে সেই চিহ্ন। সম্প্রতি বাংলাদেশের পরিচালক নুহাশ হুমায়ূন পরিচালিত ‘পেটকাটা ষ’ সিরিজের প্রথম গল্পেই দেখা মিলেছিল মেছো পেত্নির। বাঙালির চিরকালীন মিথের আবহকে তুলে ধরতে শুরুতেই এই প্রেতিণীর আগমন নেহাত কাকতালীয় নয়। সম্ভবত বাঙালির তীব্র মাছপ্রীতির ধারাকেই ব্যবহার করতে চাওয়াই আসল উদ্দেশ্য ছিল নুহাশের।
রায় গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে দেখতে পাই দেবী অন্নদার কাছে ঈশ্বরী পাটনি চাইছেন, তাঁর সন্তান যেন দুধে-ভাতে থাকে। এই দুধ-ভাতও বাঙালির এক চিরকালীন টার্ম। খুব ছোট কাউকে খেলায় নিতে বাধ্য হলে আমরা তাকে ‘দুধে-ভাতে’ করে রাখি। অর্থাৎ সে কোনও প্রতিযোগিতায় থাকবে না। সে আদুরে। কিন্তু এরই সমান্তরালে রয়ে গিয়েছে ‘মাছে-ভাতে’ শব্দবন্ধও, যা বাঙালির অন্যতম আর্কিটাইপ। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন, ”ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল/ ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।” বাঙালির ‘বেঁচে থাকা’ ও ‘ভাত-মাছ’কে গুপ্ত কবি একসারিতে বসিয়ে গিয়েছেন সেই কবে। মনে রাখতে হবে মাংস কিংবা ডিম নয়, মাছই।
কিন্তু বাঙালির মাছ খাওয়া শুরু কবে? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। সেখানেই নদীমাতৃক বঙ্গদেশে নানা পেশার মানুষের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁতি থেকে ব্যাধ কিংবা ডোম অথবা ছুতোর রয়েছেন নানাজন। এঁদের মধ্যেই দেখা মেলে ধীবর অর্থাৎ জেলেদেরও। চর্যার তেরো নম্বর পদে কাহ্নপাদের লেখায় ফুটে ওঠে মাছ ধরার দৃশ্য- ‘তরিত্তা ভবজলধি জিম করি মাআ সুইনা।/ মাঝ বেণী তরঙ্গ ম মুনিআ।/ পঞ্চ তথাগত কিঅ কোডুআল।/ বাহঅ কাঅ কাহ্নিল মাআজাল।।’ মাঝনদীতে জাল ফেলে মাছ ধরার এই দৃশ্য বুঝিয়ে দেয় ভাত খাওয়ার মতোই বাঙালির মাছ খাওয়ার সংস্কৃতিও সুপ্রাচীন! অর্থাৎ সেই আদ্যিকাল থেকেই।
এপ্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ বইয়ে পাচ্ছি পাহাড়পুর ও ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলকগুলির কথা। সেখানেও মাছ কোটা কিংবা হাটে মাছ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য খোদাই রয়েছে। এরকম প্রাচীন নিদর্শন আরও রয়েছে। মঙ্গলকাব্যই ধরা যাক। মনসামঙ্গলে বরিশালের বিজয়গুপ্ত লিখেছেন, ‘…রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ/ মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ/ ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ/ ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূত।।’ ভাবা যায়? মাছের পদের কী বাহার!
প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গদেশের পটচিত্রেও রয়েছে মাছবিলাসের কথা। বিশিষ্ট পট বিশেষজ্ঞ অঞ্জন সেনকে এপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ”পটচিত্রে মহিলা মাছ বিক্রেতা বা তথাকথিত মেছুনিদের দেখা মেলে। তাছাড়া ইতিউতি মাছ হাতে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও চোখে পড়ে। উনিশ শতকের বাবু চিত্রেও ব্যঙ্গার্থে মাছের ব্যবহার তো রয়েছেই।” আরেক পট বিশেষজ্ঞ প্রসেনজিৎ দত্ত আবার শোনালেন মাছের বিয়ের কথা। জড়ানো পট বা দীঘল পট, যেখানে আড়াআড়ি কিংবা লম্বালম্বি ছবি এঁকে গল্প বলা হয়, সেখানে মাছের বিয়ের গল্প ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রসেনজিতের কথায়, ”এমনও পট দেখেছি, যেখানে পালকিতে দু’জন মাছকে দেখা যাচ্ছে। যাদের একজন বর, অন্যজন কনে। আর সেই বিয়ে দিচ্ছে মানুষ ও অন্যান্য জীবরা মিলে।”
মাছের বিয়ের কথা উঠলে একটি প্রচলিত গানের কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘চ্যাং মাছে বলে মাঝিভাই আমাকে না মারিও/ কাল দারিকার হইব বিয়া রে, আমি বরযাত্রী যামু…’ দারিকা মাছের বিয়েতে হরেক মাছের বরযাত্রী হওয়ার সেই গান কার লেখা, কার সুর কেউ জানে না। বাঙালির মৎস্যপ্রীতির মতোই এই গানও বঙ্গদেশের জল-মাটি-হাওয়ার মধ্যে মিশে গিয়ে বাঙালির সংস্কৃতিতে মাছের চিরকালীন আবেদনকে ফুটিয়ে তুলেছে। কত রকম মাছের কথাই যে আছে! বউভোলানি, জটা বগিলা, মাথাড্যাঙানি… এই বিচিত্র সব নামের ডাক চোখের সামনে নানা মাছের পসরা বসিয়ে দেয়।
কেন? কেন মাছের প্রতি বাঙালির এই অদম্য আকর্ষণ? এর উত্তর দিচ্ছেন নীহাররঞ্জন রায়। তিনি লিখছেন, ‘বারিবহুল, নদনদী-খালবিল বহুল, প্রশান্ত-সভ্যতাপ্রভাবিত এবং আদি-অস্ট্রেলীয়মূল বাংলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগণিত হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়।’ তিনি উল্লেখ করেছেন চিন, জাপান, ব্রহ্মদেশ, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের সঙ্গে বাঙালির ভূপ্রাকৃতিক সাদৃশ্যের কথা। বাঙালির মতো তাদেরও মাছের প্রতি আকর্ষণ অমোঘ। এমন কথাও শোনা যায়, মাছ খাওয়া নিয়ে কম্পিটিশনে বাঙালিকে বলে বলে গোল দেবে জাপানিরা। যাই হোক, জাপানিদের সঙ্গে জিতুক না জিতুক বাঙালির মৎস্যপুরাণের মহিমা তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না।
কিন্তু কেন মাছ খাওয়া নিয়ে বাঙালিকে খোঁটা সইতে হয়েছে বারে বারে? এপ্রসঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘বাঙালির ইতিহাস’, যা কিনা নীহাররঞ্জনের বইয়েরই এক সংক্ষিপ্ত ও চলিত সংস্করণ, সেখানে লেখা হয়েছে, ‘নিরামিষ আহারে বাঙালির কোনওদিনই রুচি নেই।… বাঙালির এই মৎস্যপ্রীতি আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি কোনওদিনই ভাল চোখে দেখেনি।… আর্য্য-ব্রাহ্মণ্য ভারত ক্রমেই নিরামিষ আহারের পক্ষপাতী হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে এই প্রভাব ছড়িয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি।’ এই ভাবেই অতীতের বিস্মৃত সময়কাল ধরে রেখেছে বাঙালির ‘মৎস্যপ্রীতি’র ঐতিহ্যকে। অন্যদের অপছন্দ, তাতে বাঙালির থোড়াই কেয়ার। কাজেই এত বছরের ঐতিহ্যকে রক্তের মধ্যে বহন করতে করতে বাঙালি আজ যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে মাছ খাওয়া নিয়ে ন্যূনতম খোঁটাও সে সইতে রাজি নয়। কিছুতেই না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.