সরোজ দরবার: এটা কি নাটক না দেশদ্রোহ? প্রশ্ন উৎপল দত্তের নয়। বরং তাঁর উদ্দেশ্যেই ছুড়ে দেওয়া এ প্রশ্ন। প্রশ্নকর্তা মেমারির প্রিয়নাথ ঘোষ। কে তিনি? আমরা তাঁকে পেয়েছি কল্লোল নাটকের বিজয়োৎসবের হ্যান্ডবিলে। সেখানেই লেখা ছিল তাঁর গল্প। রামকৃষ্ণের আশীর্বাদপূত রঙ্গমঞ্চে মজুরের পদসঞ্চার তাঁকে পীড়া দিয়েছিল। কল্লোল দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি তাই এ প্রশ্ন করেছিলেন। তারপর গিয়ে জোয়ানদের জন্য রক্ত দিয়েছিলেন। এবং সবিস্ময়ে আমরা দেখব, সেদিনই প্রিয়নাথের পুত্র মিলিটারির গুলিতে নিহত হয়ে দেশের মাটিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকবে। প্রিয়নাথ তারপর ফিরে এসেছিলেন কল্লোলের কাছে। আর সেদিন শান্ত সমাহিত মানুষটিকে মনে হয়েছিল, ‘বিস্ফোরণের অপেক্ষায় অধীর ক্ষুদ্র একটি বোমা’। হ্যান্ডবিলে এই প্রিয়নাথের গল্প বলেই লিটল থিয়েটার গ্রুপের সভ্যবৃন্দ অঙ্গীকার জানিয়েছিলেন দরিদ্র পিতার কাছে। জানিয়েছিলেন, ‘চিরদিন মিনার্ভা কুলিমজুরের আর/ মেহনতি মানুষের/চিরদিন মিনার্ভা/প্রিয়নাথ ঘোষের।’ সেই সঙ্গে ছিল সকলের প্রতি আহ্বান, ‘আপনাকে আসতে হবে’।
এই হ্যান্ডবিলের কথা পাওয়া যায় উৎপল দত্ত সম্পর্কে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার অনুলিখনে (সায়ক নাট্যপত্র, বিশেষ নাট্যসংকলন সংখ্যা, ২০১১)। আজ উৎপল দত্তের জন্মদিনে এই হ্যান্ডবিলের কবিতাকেই সামনে রাখছি কারণ, যে কোনও বিক্ষুব্ধ সময়ে, সংশয়ে আকীর্ণ সময়ে, দ্বন্দ্বে দীর্ণ যে কোনও মানুষের কাছে এই হ্যান্ডবিল একটা আশ্রয়ের মতোই মনে হয়। এবং উৎপলবাবুর দর্শনের সেই আশ্রয়ের কাছে হাত ধরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব। শেষ পর্যন্ত তাই আমাদের তাড়িত করে, ওই ডাক- ‘আপনাকে আসতে হবে’।
কোথায় আসতে হবে? নাটক দেখতে বা বিজোয়ৎসবে? সে তো বটেই। কিন্তু প্রজন্ম পেরিয়ে আমাদের কাছে এই আসা এক অর্থে উৎপলবাবুর দর্শনের কাছেই। তাঁর রাজনীতির কাছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয়ের কাছে। সময়ে সময়ে সেই একই দ্বিধা যে কোনও সচেতন মানুষকেই ছিন্নভিন্ন করে। মনে হয়, যে মতে বিশ্বাস রাখছি, সেটা যদি ভুল হয় তখন? তখন কাকে সমর্থন, তার স্বরূপ কী, নাকি ভ্রান্তি সত্ত্বেও নিজ মতের প্রতিই দৃঢ় থাকা শ্রেয়? – ইত্যাদি প্রশ্নের জাল ক্রমশই একজন সচেতন মানুষকে আচ্ছন্ন করে। এবং এখান থেকেই এই ‘আসতে হবে’র ডাক। ওই সংশয়ের অবস্থানে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে কী কর্তব্য- তা স্থির করার ক্ষেত্রেই যেন এই আহ্বান। উৎপলবাবুর রাজনৈতিক অবস্থান আমাদের অজ্ঞাত নয়। যাঁরা ‘শের আফগানের টিনের তলোয়ার’ দেখেছেন, তাঁরা জানেন উৎপল দত্ত হয়ে সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কী জোর গলায় ঘোষণা করেন যে ‘আমি শিল্পী নই, প্রোপাগান্ডিস্ট’। যে মতে, যে রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস রাখেন, তাঁর হয়ে তিনি কথা বলবেন সে তো স্বাভাবিকই। সে কারণে রাজনৈতিক নাটক তাঁকে লিখতে হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যখন সেই মতের মধ্যে ভ্রান্তি বেরুচ্ছে, সেই রাজনীতির ভিতর বিভ্রম স্পষ্ট হচ্ছে, তখন একজন শিল্পী ও সচেতন মানুষ কী করবেন? উৎপলবাবুর রাজনীতি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, কিছু কিছু মানুষকে নিজের সঙ্গে একটা প্রাইভেট লড়াই লড়তে হয়। উৎপলবাবুও যুঝেছেন। এবং সেখান থেকে স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছেন যে, যে আদর্শে তিনি বিশ্বাস রাখেন, তা দুর্বল হয়, এমন কোনও ঝুঁকি তিনি নেবেন না। বরং তিনি চোখ ফেরাবেন ইতিহাসের দিকে। ইতিহাস থেকে ঘটনা তুলে এনে তিনি বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন। কোনও তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, এ নয় তো ও- এই জাতীয় চটজলদি সমর্থনও নয়, একটা বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে সংকটের স্বরূপ চিনে নেওয়া জরুরি। এবং সেখান থেকেই একটা বড় ভাবনার রাস্তা খুলে যাবে, শমীকবাবু যাকে বলছেন ডিসকোর্সে পৌঁছানো। যে কোনও পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিচার করতেই হবে, তবে তা তাৎক্ষণিকের নয়। একটা সংকট মোকাবিলার রসদ আমাদের ইতিহাস অভিমুখী হয়ে চিনে নিতে হবে।
এই শিক্ষা, ভাবনা, এই দর্শন বোধহয় আজ আমাদের কাছে সবথেকে জরুরি হয়ে উঠেছে। ‘হীরকরাজ’ উৎপল বা ‘আগন্তুক’ উৎপলকে নিবিড় শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি আমাদের চিনে নিতে হবে এই দর্শনকে। স্বাভাবিকভাবে যে কোনও বিকল্প ভাবনাকেই বারবার পড়তে হয় একই প্রশ্নের মুখে – এটা নাটক নাকি দেশদ্রোহ? আজ দেশের দিকে তাকিয়ে এ প্রশ্নটিকে তো আমরা অহরহ দেখতে পাই। নিজেরাও উত্তর খুঁজে পাই না। কখন যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল- সে বিভ্রম আমাদের দীর্ণ করে। এই ভ্রমকে পুঁজি করেই ফ্যাসিস্টের উত্থান হয়। উৎপলবাবু ছাত্রবস্থা পেরিয়েই যে ‘জুলিয়াস সিজার’ করেছিলেন, সেখানে কীভাবে ফ্যাসিস্টদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন তা আমাদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন শমীকবাবু। উৎসাহীজন সে বক্তৃতার লিখিত রূপ সায়ক নাট্যপত্রে পরে নিতে পারেন।
সুতরাং ফ্যাসিস্টের উত্থান থেকে নিজের বিশ্বাস রাখা রাজনৈতিক ভ্রান্তি- সবটাই তাঁর কাছে স্পষ্ট। সেখানে দাঁড়িয়েই একজন শিল্পীর, একজন রাজনীতি সচেতন মানুষের সমস্ত সংকট, দোলাচলের শুরু। সেই দ্বন্দ্বের ভিতর বাস এবং সেখান থেকে ডিসকোর্সে পৌঁছানোর প্রয়াস। আজ সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি সম্ভবত একই। সেই একই দ্বন্দ্ব। একইরকম ঠিক-ভুলের দোলাচল। সেই একই দেশদ্রোহের প্রশ্ন ক্রমাগত ভেসে আসছে। এখানেই উৎপলবাবুর দর্শন চিনে নেওয়া আমাদের জরুরি। চিনে নেওয়া প্রয়োজন। ইতিহাসে চোখ রাখার শিক্ষা। চিনে নেওয়া জরুরি ডিসকোর্সে পৌঁছানোর প্রয়াস। শুধু সমর্থনের জন্য সমর্থন, বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা পেরিয়ে, এই সংকট আত্মায় ধারণ করার যে শক্তি, তা ইতিহাস থেকেই আমাদের অর্জন করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা পারব কি না? চটজলদি বিচার, সমর্থনের পথ ছেড়ে আমরা আই দ্বান্দ্বিক বিচারশীলতার কাছে ফিরতে পারব কি না। তখনই মনে পড়ে মেমারির প্রিয়নাথ ঘোষকে ফিরতে হয়েছিল। আর স্বয়ং উৎপল দত্ত তো বলছেন ‘আপনাকে আসত হবে’। আমরা বুঝি, আমাদের আসতেই হবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.