চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, আসানসোল: একসময় বাংলার অর্কেস্ট্রা (Orchestra) নাইট হত তাঁর নামে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাড়িতে আনাগোনা ছিল বিখ্যাত মানুষদের। আসানসোল, দুর্গাপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ধানবাদ, পাটনায় গায়ক দুর্গা রানাকে চেনেন না বা ‘ডি রানা নাইট’ অনুষ্ঠান হয়নি এমন কোনও পাড়া-মহল্লা সম্ভবত নেই। আট কিংবা নয়ের দশক, এমনকী ২০১০ পর্যন্ত চুটিয়ে প্রোগ্রাম করেছেন তিনি। কিন্তু এখন কেউ আর আসেন না। খোঁজ খবরও নেন না। বয়স হয়েছে। ফাইলেরিয়ায় আক্রান্ত, তবুও পায়ের ব্যথা নিয়ে জলসায় গান করতে যান। এখন লকডাউন। গত চার মাস ধরে বাড়িতে কোনও আয় নেই। স্থানীয় এক কারখানায় নাইট গার্ডের কাজ করেই তাঁর দিন গুজরান।
কিশোর কুমার ও কুমার শানুর গানেই জনপ্রিয় দুর্গা রানা। প্রথাগত কোনও গানের শিক্ষা ছিল না। আদি বাড়ি নেপালে। তবে বাবা ইকুইটেবল কোল কোম্পানিতে কাজ করতেন বলে জন্ম তাঁর আসানসোলেই। পড়াশোনাও বাংলা মিডিয়ামে। প্রথমে নারায়ণ দাস, পরে কল্যাণ ডে ফ্রেজার তাঁর শিল্পসত্ত্বা দেখে অর্কেস্ট্রাতে সুযোগ দেন।
১৯৭৬ সালে শুরু। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এতটাই জনপ্রিয় হয়ে যান ডি রানা যে মাসে ৩০ দিনের মধ্যে ২৮ দিনই তাঁর অনুষ্ঠানের ডাক আসত। বিনোদ রাঠোর, অনুরাধা পাড়োয়াল, কুমার শানু, অনুপ ঘোষালদের সঙ্গে চুটিয়ে একমঞ্চে গান করেছেন। তিনিই ছিলেন সেই সময়ের যুবক-যুবতীদের হার্টথ্রব। তাঁর মধ্য দিয়েই কিশোর-শানুকে খুঁজে পান ভক্তরা। ২০১০ সালের পরেও তিনি অর্কেস্ট্রাতে ডাক পাচ্ছিলেন। কিন্তু মাস চারেক আগেই করোনা জাঁকিয়ে বসে, ফলে লকডাউন হয়। মার্চ-এপ্রিলে ৪০টির বেশি অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয় তাঁকে। আগামিদিনে পুজোর সময়ও প্রচুর অনুষ্ঠানের বুক ছিল। তবে সেই অনুষ্ঠান আর হবে কি না তাঁর সন্দেহ আছে!
জলসায় গান করার ফাঁকে তিনি ডিসেরগড়ে একটি কারখানায় সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করতেন। তাঁরই বাল্যকালের বন্ধু বিখ্যাত শিল্পপতি কল্লোল মুখোপাধ্যায় দুর্গা রানার গুণমুগ্ধ হয়ে সম্মানে এই কাজটি দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের জন্য অনিয়মিত ডিউটি ছিল তাঁর। কিন্তু করোনার আবহে গত তিরিশ বছরের অনিয়মিত ডিউটির অনভ্যাস এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দুঃসময়ের রোজগারের উপায় বা পরিবারের মুখে অন্ন জুগিয়ে দিচ্ছে ওই পুরনো কাজ। এখন নিয়ম করে ডিউটি যাচ্ছেন। মাসে তিরিশ হাজার টাকা রোজগেরে বিখ্যাত শিল্পীর এখন আট হাজার টাকা বেতনই ভরসা। বাড়িতে স্ত্রী রিনা, ছেলে উদয় রয়েছেন। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ের মৃত্যু হয়েছে ক্যানসারে। মেয়ের চিকিৎসায় জীবনের সঞ্চিত বহু টাকা চলে গিয়েছে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি তাঁকে। এখন ডিসেরগড়ে দশ ফুট বাই দশ ফুটের অ্যাসবেস্টারের ঘরে তিনি থাকেন। অর্কেস্ট্রা নাইট তাঁর কাছে এখন শুধু সোনালী স্মৃতিমাত্র।
ভাঙা ঘরে বসেই এখন ডি রানা গুনগুন করে গেয়ে ওঠেন, “মৌত আয়ি হ্যায়- আয়ে গে একদিন, জান জাতি হ্যায়- জায়েগি একদিন- অ্যাসি বাতো সে, ক্যায়া ঘাবরানা, ইঁহা কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা”।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.