নিজস্ব চিত্র।
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: এ যেন এক টুকরো মোলেলা! কথাটা অচেনা লাগছে? তবে খুলেই বলা যাক। রাজস্থানের (Rajasthan) রাজসামন্দ জেলার একেবারে ছোট্ট গ্রাম এই মোলেলা। শনি-রবি পুরুলিয়া (Purulia) শহরের কেতকায় রেল ফটকের কাছে গাছগাছালিতে ঠাসা খোলামেলা স্টুডিওর আবহ যেন রাজস্থানের ওই গ্রামকেই ফুটিয়ে তুলেছিল। সপ্তাহান্তে এখানেই ইন্টারন্যাশনাল টেরাকোটা ওয়ার্কশপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। একটি অঙ্কন সংস্থার আয়োজনে বাংলাদেশ, নেপাল-সহ এ রাজ্যের টেরাকোটা (Terracotta) শিল্পীদের নিয়ে এই কর্মশালা আলাদাভাবে নজর কাড়ে। ওই অঙ্কন সংস্থার কর্ণধার তথা চিত্রশিল্পী ভাস্কর ঘোষ বলেন, “এই ধরনের কর্মশালা সফলভাবে করার জন্য এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি চলছিল। এই প্রথম পুরুলিয়ায় আন্তর্জাতিক মানের টেরাকোটা কর্মশালা হলো।”
গাছ-গাছালির নিচে চট পেতে দেশ-বিদেশের শিল্পীরা মাটি, কাদা নিয়ে টেরাকোটার ভাস্কর্য (Sculpture) তুলে ধরছেনl কোনও শিল্পীর হাতের কাজে মায়ের কোলে সন্তান, আবার কেউ দেবদেবী, কেউ বা জনজাতির মহিলাকে ফুটিয়ে তুলছেন। একনজরে দেখলে মনে হবে, আক্ষরিক অর্থেই কোনও টেরাকোটা শৈল্পিক গ্রাম। যেখানে মানুষের নানান মূর্তি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। মৃৎশিল্পের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এই টেরাকোটার শিল্প। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের পাঁচমুড়া এই শিল্পের জন্য বিখ্যাত। তবে সেখানে মূলত হাতি, ঘোড়ার উপরই এই কাজ হয়ে থাকে। কিন্তু পুরুলিয়ায় সপ্তাহান্তের এই আন্তর্জাতিক টেরাকোটা কর্মশালায় নানা ধরনের মানুষের অবয়ব চমক লাগাল।
টেরাকোটা একটি লাতিন শব্দ। টেরা-র অর্থ মাটি। কোটা-র অর্থ পোড়ানো। মানুষের ব্যবহার করা পোড়ামাটির জিনিসপত্র টেরাকোটা নামে পরিচিত। আঠালো মাটির সঙ্গে খড়কুটো, তুষ মিশিয়ে কাদা, মাটি থেকে মূর্তি-সহ নানা অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়। তার পর তা রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে টেরাকোটার ভাস্কর্যের রূপ পায়। আন্তর্জাতিক মানের কর্মশালায় (Workshop) এই বিষয়টি এদিন প্রার্থীদের কাছে তুলে ধরেছিলেন দেশ-বিদেশের শিল্পীরা। ইতিহাস বলছে, সুমেরীয় সভ্যতায় টেরাকোটা শিল্পের প্রচলন ছিল। এছাড়া মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্যে বহু টেরাকোটার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
রাজস্থানের মোলেলার মতোই বাঁকুড়ার (Bankura) পাঁচমুড়া টেরাকোটা শিল্পের জন্য বিখ্যাত। ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর বা তার আগে সিন্ধু সভ্যতায় টেরাকোটা নিদর্শন পাওয়া যায়। বাংলাদেশেও এই শিল্পের সোনালী অতীত রয়েছে। তাই তো এই আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বাংলাদেশ থেকে পুরুলিয়ায় আসেন প্রখ্যাত শিল্পী নাফিসা ইসলাম অনন্যা ও সুরভি আখতাব। নাফিসা বলেন, “অঙ্কনের নানা কাজে বাংলায় এসেছি। কিন্তু এই প্রথম টেরাকোটা কাজ নিয়ে বাংলায় এলাম। তবে আমাদের দেশ আর বাংলার কোনও তফাত নেই। এখানে এসে সেটাই বার বার মনে হয়। পুরুলিয়া শহরের এই কর্মশালায় এসে খুব ভালো লাগল। এই ধরনের কর্মশালা থেকে সংস্কৃতির আদানপ্রদান হয়। এটা একটা বড় পাওনা।” নেপালের কাঠমান্ডু থেকে আসা বিনোদ কুমার গুপ্তা, জয়া শর্মাদের কথায়, “একসঙ্গে এত শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে পারব, এটা ভাবতেই পারিনি। এখানকার পরিবেশটা খুবই ভালো।”
পুরুলিয়ার কেতকার বাসিন্দা শিল্পী ভাস্কর ঘোষের অঙ্কন স্কুলের আয়োজনে পুরুলিয়ায় এই প্রথম টেরাকোটার আন্তর্জাতিক কর্মশালায় ৫০ জন শিল্পী অংশ নেন। যার মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল থেকে সাতজন। বাকিরা এই জেলা-সহ হাওড়া, কলকাতা, খড়গপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান থেকে যোগ দেন। শনি-রবি দুদিনের এই কর্মশালায় যেমন সংস্কৃতির আদানপ্রদান। তেমনই এই শিল্পকলাকে নিয়ে নানা আলোচনা। হাতে-কলমে শিক্ষা। সেইসঙ্গে রবিবার কর্মশালা শেষে বসন্ত উৎসবেও মাতলেন শিল্পীরা। হলো ক্যাম্প ফায়ার, খাওয়াদাওয়া।
দেখুন ভিডিও:
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.