বিশ্বদীপ দে: ‘আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী।’ আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এমন কথা যিনি উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর নাম নজরুল ইসলাম। ২৩ নভেম্বর, ১৯২২। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদক নজরুলকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরের বছরের শুরুতেই বিচারাধীন বন্দি হিসেবে তিনি আদালতে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ হিসেবে বিখ্যাত। এই লেখার শুরুতেই যে কয়েকটি বাক্য তুলে ধরা হল তা ওই জবানবন্দিরই অংশ। ২৭ জানুয়ারির সংখ্যায় ‘ধূমকেতু’র পাতায় তা প্রকাশিতও হয়েছিল। এক শতাব্দী পেরিয়ে এসে নতুন করে নজরুলের সেই জবানবন্দি যেন মহাকালের মন্দিরা হয়ে বেজে উঠছে। সম্প্রতি নবদ্বীপের রাধারাণী মন্দিরের হিন্দু নাটমন্দিরে যা ঘটেছে, তারপর বাঙালির বোধহয় ফের একবার নতুন করে নজরুলকে উপলব্ধি করা দরকার হয়ে পড়েছে।
নাটমন্দিরে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা চলাকালীন ‘মুসলমান’ নজরুলের (Kazi Nazrul Islam) ছবি সেখানে রাখা যাবে না- এমন নিদান নাকি খোদ মন্দির কমিটিরই! তবে তারা হয়তো বুঝতে পারেনি বিতর্কের ঝড় কতটা ব্যাপক হতে চলেছে। পরে ঢোঁক গিলে ক্ষমা চেয়ে নিলেও এত সহজে এই উদ্বেগ থেকে মুক্তি নেই আমাদের। নজরুলকেও তাহলে ধর্মের নিক্তিতে বিচার করতে হবে! তাও জাত-ধর্মের আগল ভেঙে ফেলা ভক্তি আন্দোলনের জনক শ্রীচৈতন্যের জনপদে! এক আশ্চর্য আঁধারে দাঁড়িয়ে গুলিয়ে দেওয়ার এই খেলাকে সম্যক বুঝে নিয়ে সাবধান হওয়া আশু প্রয়োজন। এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে। এরপর কত কী যে হারিয়ে ফেলব!
অথচ নজরুল। সাম্প্রদায়িক বিভেদের জিগির যাঁরা তোলেন, তাঁদের সামনে এক অনতিক্রম্য হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। কিন্তু তাঁকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চক্রান্তের শিকার হতে হচ্ছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যাবে এক ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদীকে। ইংরেজের শোষণ ও অত্যাচারে কুঁকড়ে যাওয়া এক জাতিকে জাগিয়ে তুলতে এমনই মহামানবকেই সেই সময় প্রয়োজন ছিল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামের এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘এই জীবনকে বলা উচিত মহাজীবন। কারণ এর মধ্যে লুকানো রয়েছে একটি সনাতন তপস্যা। সে তপস্যা কবিযশ নয়… সে তপস্যা ঈশ্বরকে জানার তপস্যা। সৃষ্টির আদিম প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে তপস্যা- এ তপস্যা তাই।’
‘অগ্নিবীণা’র কবিতাগুলির নামের দিকে দেখলেই চোখে পড়বে একদিকে ‘কোরবানি’, ‘মোহররম’, ‘শাত-ইল-আরব’-, অন্যদিকে ‘আগমণী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’- ইসলামিক ও হিন্দু শব্দের এই বৈচিত্র লক্ষণীয়। যা বুঝিয়ে দেয়, শুরু থেকেই জাতি-ধর্মের বেড়া ভেঙে সবকিছুকে সঙ্গে করেই এগিয়ে চলতে চেয়েছেন বছর তেইশের নজরুল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল বলেছিলেন, ‘মম এক-হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য’। অর্থাৎ একদিকে নিপীড়িত জাতিকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র বুনছেন তিনি। অন্যদিকে সেই তিনিই লিখছেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই/ যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’
সেই মানুষটি আবার জগন্মাতার উপাসনায় লিখতে বসছেন শ্যামাসংগীতও। লিখছেন ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’, ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে’ অথবা ‘কালো রূপে মন ভুলালে কালোকে আয় বাসবি ভাল’ বা ‘শ্মশানে জাগিছে’র মতো গান। প্রায় আড়াইশোটি শ্যামাসংগীত। রামপ্রসাদ সেন ছাড়া সম্ভবত এতগুলি শ্যামাসংগীত আর কেউ লেখেননি। গান লেখাই কেবল নয়, অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে কালীসাধনা ও করতেন নজরুল। আসলে স্ত্রীর অসুস্থতা ও ছেলে বুলবুলের অকালপ্রয়াণে আরও বেশি করে নিজেকে মা কালীর চরণে সঁপে দিয়েছিলেন তিনি। এই ভক্তির পিছনে সম্ভবত বড় প্রভাব ছিল লালগোলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বরদাচরণ মজুমদারের। তন্ত্রসাধক এই মানুষটির সাহচর্যেই নজরুলের মনের ভিতরে আরও বেশি করে বিকশিত হয়েছিল কালীভক্তি। এরই পাশাপাশি অবশ্য নজরুল বিশ্লেষণ করেছেন শ্রীশ্রীচণ্ডীর তত্ত্ব। গান লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়েও।
ধর্মবিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়েই মানবপ্রেম ও সৌভ্রাতৃত্বের বাণীই যেন রচনা করতে চেয়েছেন আমাদের ‘বিদ্রোহী’ কবি। এই ‘বিদ্রোহী’ তকমাটি অবশ্য নজরুলকে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ভিতরে বেঁধে রাখতে চায়। তিনি যে কেবল বিদ্রোহী নন। তিনি প্রেমিক, তিনি ধর্মপ্রাণ এক মানুষ। তাঁকে সামগ্রিকতায় বিচার করলে বোঝা যায়, কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছেন তিনি। অথচ মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবন তাঁর। এত অল্প সময়ে এই বৈচিত্র অভাবনীয়। তেমনই অভাবনীয় এই মানুষটিকে স্রেফ ‘মুসলমান’ তকমায় আটকে রাখার ঘৃণ্য প্রবণতা। মনে পড়ে যায়, পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) একসময় নজরুলের কবিতার ‘পাকিস্তানি সংস্করণ’ প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেসব শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ১৯৪৯ সালে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয়নিকো নজরুল’। এই অমোঘ উচ্চারণেই ধরা আছে বাঙালির কাছে নজরুলের আসল ছবিটা।
যদিও সেই ছবিই যে একমাত্র নয়, তা বুঝতে মনে রাখা দরকার ১৯৭৬ সালে অন্নদাশঙ্করই অভিমানভরে লিখেছিলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/ এতকাল পরে ধর্মের নামে/ ভাগ হয়ে গেল নজরুল।’ সেই ভুল আমাদের এখনও ভাঙেনি বুঝি। প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে না হলে নিদান দেওয়া হয়, নজরুলের ছবিতে মাল্যদান করা যাবে না। কেননা তিনি ভিন্ন ধর্মের মানুষ! ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ তাহলে নিছকই লিখে ফেলেছিলেন তিনি? এমন বিশ্বাস বাঙালির শিকড়ে পুঁতে দেওয়ার অপপ্রয়াস অবশ্য এত সহজে সফল হবে না। বিতর্কের অব্যবহিত পরেই ওঠা প্রতিবাদের ঝড় অন্তত সেই আশ্বাসটুকু দিচ্ছে।
ত্রিপুরাশঙ্কর সেনের লেখা প্রবন্ধ ‘কবি নজরুলের ধ্যানে দেশ-মাতৃকা ও জগন্মাতা’য় পাচ্ছি নজরুলের বক্তব্য, ‘আমার চিন্তায় বেদান্তদর্শনের প্রভাব রয়েছে। বেদান্ত বলেন, জীব মাত্রেই ব্রহ্ম। মানুষ যখন নিজেকে ব্রহ্ম বলে জানতে পারে, তখনই সে মুক্ত হয়ে যায়।’ এই মুক্তিই ছিল তাঁর অভীষ্ট। এই মুক্তিই ছিল তাঁর পথ। হিন্দু-মুসলমান বা নারী-পুরুষ কোনও বিভেদের ঘেরাটোপকেই মানতে চাননি তিনি।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে স্মৃতিকথার উল্লেখ আগে করা হয়েছে, সেখানে রয়েছে একটি আশ্চর্য ঘটনার কথা। ১৯৪০ সাল। পুজোর পরই পুত্রহারা হয়েছেন তারাশঙ্কর। সেইদিনই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন নজরুল। দু’জনের মধ্যে সেই প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয়। তারাশঙ্কর লিখছেন, ‘পরদিন কাজী সাহেব আমাদের গ্রামের ফুল্লরা দেবীর (মহাপীঠ রূপে খ্যাত) স্থানে গেলেন। এবং মন্দিরের সম্মুখে নাটমন্দিরের উপর পদ্মাসন হয়ে বসে প্রাণায়াম সহযোগে যে জপ করেছিলেন তা দেখে একথা বলব যে এই ব্যক্তি এক আশ্চর্য চরিত্র ব্যক্তি…’।
এই নজরুল আমাদের রক্তের ভিতরে মিশে রয়েছেন আলোয় উদ্ভাসিত উত্তরাধিকার হয়ে। ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’র এক অংশে সদ্য তরুণ নজরুল জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘রাজার বাণী বুদ্বুদ্, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র।’ সেই সমুদ্র বাঙালির চেতনায় জেগে থাকুক। নজরুলের ছবি সরিয়ে নেওয়ার পর সেখানে সৃষ্টি হওয়া শূন্যস্থানকে ভাসিয়ে এই কঠিন সময়ে তাঁর বাণী আমাদের আলোর দিকে নিয়ে যাক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.