Advertisement
Advertisement
Durga puja

বিসর্জনের বিষাদ ভুলে ‘আসছে বছর আবার হবে’ শেখায় ভাসান-নৃত্য

‘হাম হাম গুড়ি গুড়ি’ থেকে ‘হামাগুড়ি’ সবই চলে ভাসানের নাচে।

A write up on Durga puja and Bhasan dance
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:October 12, 2024 5:19 pm
  • Updated:October 12, 2024 5:38 pm  

বিশ্বদীপ দে: নবমী নিশির ফুরিয়ে যাওয়া এক সাংঘাতিক বিষাদ। আমাদের সকলেরই বোধহয় পুজো ছাড়াও অনেকবার ‘নবমী নিশি’ পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই ‘না হইও রে অবসান’ বলে কাকুতি মিনতি করলেও যে শেষমেশ কোনও ফল হবে না তা বিলক্ষণ জানা। অগত্যা দশমী। এবং ভাসান। আর ভাসান মানেই তার সঙ্গে জুড়ে থাকা হাজারো অনুষঙ্গের অন্যতম হয়ে ফিরে আসে ভাসান-নৃত্য। সেখানে কিন্তু বিষাদ নয়, রয়েছে ঠিক উলটোটা। গানের তালে, ঢাকের তালে, তাসা পার্টির বাজনার তালে এমনকী প্রয়োজনে গান বন্ধ থাকলে জেনারেটরের তালে তালেও কোমর-সহ সর্বাঙ্গে যে হিল্লোল- তা এক আশ্চর্য অনুপম ব্যাপার স্যাপার। ‌ধুনুচি নাচের মৃদু আভিজাত্য, ভক্তির প্রকাশ এখানে নেই। বিষয়টা নিখাদ সাব অল্টার্ন। দুর্গাপুজো বা বিশ্বকর্মা পুজোর মতো অসংখ্য পুজোশেষের মুহূর্তে এক অবধারিত কার্টেন রেজার এই নাচ। তথাকথিত গুম্ফশ্মশ্রুময় সমাজের হর্তা কর্তারা এসব দেখে যতই নাক সিঁটকোন, ভাসানের নাচ রয়েছে ভাসানের নাচেই।

আজকের রিলস প্রজন্ম বাসে-ট্রেনে, পারলে শ্মশানেও ‘পরম পরম পরম পরম পরম সুন্দরী’ নেচে চরম ভিডিও বানিয়ে ফেলতে জানে। কিন্তু সেই দেখনদারি থুড়ি লাইকপ্রত্যাশা-সর্বস্ব নাচের সঙ্গে ভাসানের নাচের কোনও সম্পর্ক নেই। এই নাচ আসলে এক স্টেটমেন্ট। ‘আমাকে দেখুন’ মার্কা কোনও আর্জি না জানিয়ে স্রেফ নিজেকে নিয়েই লোকারণ্যে মেতে ওঠার নামই ভাসানের নাচ। হ্যাঁ, এই মেতে ওঠার ক্ষেত্রে সোমরস কিংবা সিদ্ধিলাভের একটা ক্যাটালিস্ট-ভূমিকা থাকেই। আমাদের পাড়ায় শম্ভু নামের এক ভ্যানচালক ছিলেন। দিবারাত্র নেশা তাঁকে ঘিরে রাখত স্যাটেলাইটের মতো। সেই মানুষটাকে একবার দেখেছিলাম ভাসানের আগে ক্লাবের ছেলেদের নাচের মহিমা দেখে হাততালি দিতে দিতে ‘রগড় রগড়’ বলে চেঁচাতে। সারা বছর যারা তাঁর মদ্যপ জীবন নিয়ে প্যাঁক দেয়, সেই তারাই তখন ‘জলের তলায়’ অ্যাকোয়া ডান্স করে চলেছে। এমন মোক্ষম পালটা আওয়াজ দেওয়ার মওকা কেউ ছাড়ে? কথাতেই আছে ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক’। কিন্তু যাদের উদ্দেশে এই টিটকিরি, তারা কেউ আদৌ তা বুঝতে পেরেছি‌ল? তারা যে তখন ‘দো ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে’ আর্তিতে মশগুল।

Advertisement

বহু বছর আগে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় স্বর্গের ঊর্বশীদের শেখানোর সময় তামাম বাঙালিকেই ‘হাম হাম গুড়ি গুড়ি’ নাচ শিখিয়েছিলেন। ভাসান নাচে বাঙালি অবশ্য ‘হাম হাম গুড়ি গুড়ি’ থেকে ‘হামাগুড়ি’ সবরকমই নৃত্যকৌশল প্রয়োগ করে থাকে। যার যত অদ্ভুত স্টেপ, তার তত দর। এবিষয়ে অবশ্য বিশ্বকর্মা পুজো সবাইকে টেক্কা দেবে। বলতে গেলে শারদোৎসবের প্রকৃত সূচনা বিশ্বকর্মার আবাহন থেকেই শুরু হয়। আর সেই পুজোকে ঘিরে যাঁদের সবচেয়ে বেশি আনন্দ, তাঁরা ভ্যান ও রিকশা চালকরা। অটো বা ট্যাক্সি চালকরাও রয়েছেন। বিভিন্ন কারখানার ভিতরে কেমন নাচ হয়, সেটা সব সময় ঠাহর করা যায় না। কিন্তু রাস্তার মোড়ের এই সব রিকশা কিংবা ভ্যান অ্যাসোসিয়েশনের পুজোয় ভাসান বা তারও আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় ডান্স শো। ব্রেক কিংবা টুইস্ট, সালসা এসব নয়। অথবা এই সবই হয়তো মিশে থাকে এখানকার নাচে। আজকাল অনেকে আবার সেই নাচের ভিডিও তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে দেয়। নেটিজেনরা সেসব নিয়ে দেদার খিল্লিও করে। কিন্তু এসবে এঁদের কোনওদিনও কিছু এসে যায়নি। যাবেও না।

বিশ্বকর্মা পুজোর সঙ্গে দুর্গাপুজোর ভাসানের নাচের অনেকের ফারাক রয়েছে। এখানে সদ্য নেশায় হাত পাকানো তরুণ থেকে ‘শিং ভেঙে বাছুর’ সাজা কাকু-জেঠুরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নাচে। সারা বছর গম্ভীর থাকা আইটি কর্মীও কখন সেই ভিড়ে মিশে যাবে ধরতে পারবেন না। পুজোর কটা দিনের ‘কথা দিলাম’ থেকে ‘প্রিয়তমা মনে রেখো’, কিংবা ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’, ‘সকল দর্শনার্থীকে জানাই প্রীতি-শুভেচ্ছা’ পেরিয়ে নানা প্রান্তে বেঁধে রাখা মাইক তখন ‘দিলবর দিলবর’ বাজাচ্ছে তড়বড় তড়বড় করে। ‘নয়নী সরসী কেন ভরেছে জলে’, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা মুলতুবি রেখে সে তখন গোটা পাড়াকে ডাকছে ‘জিমি জিমি জিমি আজা আজা আজা’… বরণের ভিড়কে সাইডে রেখে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে জুটে গিয়েছে ছেলেছোকরারা। ক্রমে বয়সে বড়রাও আসবে। নৃত্যপটু হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কেউ স্রেফ কোমরটা দুলিয়ে যাবে। কেউ আবার গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে ঘোরানোর ভঙ্গি করবে। পাড়ায় রাজু বলে একটা ছেলে ছি‌ল। ওকে আমরা প্রভু দেবা বলতাম। কিন্তু সেও ভাসানের ভিড়ে জাস্ট অন্যরকম। বলত, ‘‘এখানে ওসব স্টেপ চলবে না।’’ ও ভালোই বুঝেছি‌ল তথাকথিত পালিশ করা চকচকে স্টেপসমগ্র ভাসানে ব্রাত্য। এখানে কিম্ভুত, অদ্ভুতরাই রাজা। মোদ্দা কথা হল, বিসর্জনের বিষণ্ণতা কিংবা উৎসব শেষের মনখারাপকে ভুলতে এই প্রাণখোলা নাচের কোনও বিকল্প নেই। কেননা এই নাচ তাকে মনে করিয়ে দেয়, জীবনে যে মুহূর্ত চলে যাচ্ছে তাকে জোর করে আটকে রেখো না। বরং বিশ্বাস রাখো ‘আসছে বছর আবার হবে’।

এমনিতে বাঙালিরা জন্মেই ‘জ্যাঠা’ হয়ে ওঠে। একটা ‘সিরিয়াস’ ভঙ্গিতে সব কিছু নিয়েই তার নানা ওজর-আপত্তি। নির্দোষ মজাকেও সে গম্ভীর গলায় ‘ছ্যাবলামি’ বলে দেগে দিতে শিখে যায় খুব দ্রুত। জীবনের সহজ আনন্দকে প্রশ্ন করে সেটাকে উপভোগের বারোটা বাজানোয় তার জুড়ি নেই। তবুও সেই বাঙালির একটা বড় অংশ কী করে ভাসানের নাচে শামিল হয়ে যায়, তা রীতিমতো কাল্টিভেট করে দেখার বিষয়। প্রান্তিক মানুষের কোনও ব্যাগেজ থাকে না। কিন্তু মধ্যবিত্তর তো থাকে। উচ্চ মধ্যবিত্তরও। অথচ পাড়ার ভাসানে সব এক হয়ে যায়। আশপাশের ভিড়ে বহু মানুষ যে দাঁড়িয়ে সেই নাচ প্রত্যক্ষ করে, মনে মনে তাদের সায় থাকে বলেই তারা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। বরং এক-একজনের কিম্ভূতমার্কা স্টেপ দেখে মজায় লুটিয়েও পড়ে তারা। আবার পাড়ার সদ্য কিশোরী ক্লাবের অমুকদাদার নৃত্যকৌশলে মুগ্ধ হয়েই পূর্বরাগের দিকে এগিয়ে যায়। শব্দ, জগঝম্পের ভিড়ে মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়ে এই সব নাচের হুল্লোড়ও যে কত কিছু লিখে যায়!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নাচের একটা বিবর্তনও হয়েছে। তরুণী-কিশোরীরা দূর ভিড়ে দাঁড়িয়ে না থেকে নাচের হুল্লোড়ে মিশে যেতে শিখেছে। এসেছে ডিজে। লেজার আলোর ঝলকানি ও গগনবিদারী শব্দব্রহ্মে পাড়ার প্যান্ডেল তখন ডিস্কো ঠেক। ভাসানের পসেশনেও একই দৃশ্য। কিন্তু এই ঝিনচ্যাক আবহ যেন কিছুটা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এতকালের ভাসান-নৃত্যের লিগ্যাসির সামনে। এত নিখুঁত পরিবেশ বরং অবাঙালিদের থেকে ধার করা ‘সঙ্গীতে’ (আজকাল বাঙালি গায়ে হলুদের থেকে ‘হলদি’তেই যেন বেশি স্বচ্ছন্দ) রাখা যেতে পারে। বা বিয়ের দিনও তো এমন সব দুরন্ত ডান্স পার্টির আয়োজন হয়। ভাসানের নাচকে এসবের থেকে দূরে রাখলে হয় না? সে থাকুক না তার সাব অল্টার্ন চরিত্র নিয়ে। পাড়ার মাইক, তাসাপার্টি এমনকী জেনারেটরের তালে তালেও রক্তে আগুন ছোটে সময় সময়। কে দেখছে, কী ভাববে সেসব ভুলে সমাজের মুখের উপরে তুড়ি মেরে এই নেচে ওঠাকে এমন ঝকঝকে পরিবেশে বেঁধে ফেলা যায় কি? নাকি উচিত?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement