বিশ্বদীপ দে: ‘লোকটার দেহে ভারী ওভারকোট। মাথার টুপিটা নামানো। রাজেন বাই লেনের কোণে গিয়ে লোকটা চুপ করে দাঁড়াল। সে যে গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জি, তা বোঝাই যায় না।’ দূরের পেটা ঘড়িতে যখন ঢং ঢং করে রাত একটা (!) বাজে, সেই সময়ই দেখা যায় তাকে। যার নাকি দুহাতে পিস্তল, অন্যহাতে হাতে টর্চ! এমনই সব বর্ণনা মিথ হয়ে গিয়েছে। যুগ বদলেছে আমূল। কিন্তু বাঙালির কাছে আজও গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির নামটা মুছে যায়নি। তবে একথা তো সত্যিই, তার নামটা ফেলুদা, ব্যোমকেশের মতো কৌলিন্য বহন করে না। বরং উলটোটাই। একই ভাবে তার স্রষ্টার ভাগ্যেও জুটল আশ্চর্য অবহেলা ও তাচ্ছিল্য। অথচ সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে ওরফে এসএন পাণ্ডে ওরফে স্বপন কুমারের জীবন এমনই বিস্ময়কর, ভাবলে বিশ্বাসযোগ্যই মনে হয় না। এহেন স্বপন কুমারকে (Swapan Kumar) বাঙালি বোঝেনি। তবে এবার তিনি ও তাঁর সৃষ্টি রুপোলি পর্দায়। আগামী সপ্তাহেই মুক্তি পাওয়ার কথা ছবিটির। তার আগে ছবির টিজার ও ট্রেলার সাড়া ফেলেছে। আর নতুন করে আলোচনায় ফিরছেন দুদশকেরও বেশি সময় আগে প্রয়াত লেখক।
আসলে আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের আদিযুগে একদিকে ছিল প্যারীচাঁদ মিত্র তথা টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’। অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (Bankim Chandra Chatterjee)’দুর্গেশনন্দিনী’। প্রথমটি চালু লব্জের গদ্যভাষা। অন্যটি ঝাঁ চকচকে ঝঙ্কারময় বাংলায় লেখা। চরিত্রগত ভাবে তারা একেবারেই আলাদা। এর পরই হুতোমের নকশার মতো কালজয়ী রচনার আবির্ভাব হলেও প্রথম ধারাটি থেকে গেল অবহেলিতই। বরং বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ভিক্টোরীয় পরিশীলতাকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় ধারাটিই পুষ্ট হল ক্রমশ।
অন্যদিকে বটতলা সাহিত্য। যাকে খোদ বঙ্কিমও ব্যঙ্গ করেছেন, তা আসলে খুঁটিয়ে দেখলে ওই প্রথম ধারারই এক সম্প্রসারণ। বটতলা দেবীর কাছে নিজের লেখনীশক্তি বৃদ্ধির কামনা করেছিলেন সাহিত্যসম্রাট। এটা আসলে বক্রোক্তি। বটতলা থেকে গিয়েছে নিজের মতোই। আর বিংশ শতাব্দীতে এসে সেই ধারাতেই প্রবেশ করলেন স্বপন কুমার। বলা হয় এই ধরনের সাহিত্যের আসল উদ্দেশ্যই হল মনোরঞ্জন। লেখক ও প্রকাশক স্রেফ লাভের মুখ দেখতেই এই ধরনের লেখা লিখতেন ও ছাপাতেন। ছাপাও হত এমন কাগজে যা এক-দুবার পড়তে না পড়তে ঝাপসাও হয়ে যেত। আসলে তার বেশি পড়ার দরকারই পড়ত না। হাতে হাতে ঘুরতে থাকা সেই কাহিনিতেই মুক্তি পায় দীপক চ্যাটার্জির অভিযান। আর অন্তত তিন দশক ধরে তথাকথিত ‘বিশুদ্ধবাদীদের’ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হইহই করে রাজত্ব বাঙালির ঘরে ঘরে। ফেলুদা, কিরীটি, ব্যোমকেশদের দাপটেও তাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলির (Lalmohan Ganguly) ভাষায় ‘সেলিং লাইক হট কচৌরিস’।
অথচ স্বপন কুমার চেয়েছিলেন ডাক্তার হতে। বাবা-ঠাকুর্দা ছিলেন ব্যারিস্টার। তিনিও ভর্তি হন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু পড়া শেষ হল না। পরিবারের মুখে অন্ন জোগাতে ধরতে হল কলম। দ্রুতগতিতে লিখে যেতে হল গোয়েন্দা কাহিনি। তবে গোয়েন্দা কাহিনি বলতে যা বোঝায়, তা ঠিক লেখেননি তিনি। পাতায় পাতায় খুন আর রহস্যে ভরা দীপক চ্যাটার্জি ও তার সহকারী রতনলালের অ্যাডভেঞ্চারে যুক্তি খুঁজতে যাওয়াই যে ভুল। পাঠকরা অবশ্য ওই এক্সাইটমেন্টটাই চাইতেন। মনে রাখতে হবে সে এক অন্য সময়। আজ স্ক্রিনে আঙুল বোলালেই উপর্যুপরি কনটেন্টের বন্যা। অডিও-ভিশুয়ালের দাপটের বহু দূরে তখন কেবল সিনেমা আর রেডিও। বাকি জায়গাটা বইয়ের। ছাপোষা বাঙালি এতেই খুঁজে বেড়াত মনমাতানো বিনোদন। সেই অ্যাডভেঞ্চারের মৌতাত এনে দিতেন স্বপন কুমার। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিখ্যাত দল ড্রাগন। সেই দলের প্রধান এক বার্মিজ, নাম তার ইউ। সেই লোক আট-দশটা ভাষায় নাগাড়ে কথা বলে যেতে পারে। এহেন শত্রুর মুখোমুখি দীপক। এর পর রহস্যের কুয়াশা কেমন করে ঘনায় বলাই বাহুল্য। এখানেই শেষ নয়, আরও সব জাঁদরেল ভিলেনরা আছে। কালনাগিনী, বাজপাখি, কালো নেকড়ে… একেবারে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ সব চরিত্র ও অভাবনীয় ট্রিটমেন্ট। গোপন সুড়ঙ্গ, স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, সূত্রহীন খুন- চমকের যেন শেষ নেই। ভিলেনরা শেষে অবশ্য পালিয়ে যায়। ফের ফিরে এসে প্রতিশোধ নেবে বলে। চক্রাকারে ঘুরতে থাকে কাহিনি। দীপক চ্যাটার্জিকে কেমন যেন মনে হয় বাঙালির জেমস বন্ড। বাংলাদেশের কাজি আনোয়ার হোসেন সৃষ্ট চরিত্র মাসুদ রানাও তারই স্বগোত্রীয়। আরও একজন আছে। দস্যু মোহন। শশধরের সেই সিরিজেও ছিল ‘কী থেকে কী হইল, বন্দুক মোহনের হাতে চলিয়া আসিল।’ কিন্তু এখানে একটা কথা বলা দরকার। দীপকের তিন হাত (!) কিংবা ঢং ঢং করে রাত একটা (!) বাজার বর্ণনা কিন্তু বইয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। বোঝাই যায়, এ আসলে গল্পগুলোর মানকে বোঝাতে তৈরি করা মিথ।
আর এই ব্যাঙ্গের আড়ালেই রয়ে গিয়েছেন স্বপন কুমার। যতই যুক্তিহীন, অবাস্তবতা থাকুক গল্পের গতি কিন্তু সেসব ভাবতে দেয় না। বছরের পর বছর ড্রাগন সিরিজ, বাজপাখি সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ- এই ধারা বজায় রাখা যে কতটা কঠিন! মোট কুড়িটা সিরিজ। এর মধ্যে কিছু সিরিজে শ খানেক বই! এর সঙ্গে ছিল অন্য লেখাও। ভাবলে অবাক লাগে জ্যোতিষী শ্রীভৃগুর নাম প্রায় সকলেরই জানা। তিনি ও স্বপন কুমার আসলে অভিন্ন ব্যক্তি! হ্যাঁ, একের পর এক জ্যোতিষের বইও সেই সঙ্গে লিখে গিয়েছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়। এস এন পাণ্ডে নামে লিখেছেন ডাক্তারির বই। আর সেগুলোও জনপ্রিয়। পাশাপাশি বাদ পড়েনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বইও। গাড়ি চালানো থেকে সবজি চাষ নিয়েও কলম ধরেছেন। সব বই-ই রমরমিয়ে বিকিয়েছে। জানা যায়, শিয়ালদহ স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কলম চালাতে হয়েছে স্বপন কুমারকে। বইয়ের বিক্রিতে সংসারেও এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু কুলীন লেখক তিনি হয়ে উঠতে পারলেন কই? জ্যোতিষী শ্রীভৃগু হয়ে অবশ্য তিনি বিপুল খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু স্বপন কুমারের খ্যাতি যেন ছায়াচ্ছন্নই রয়ে গিয়েছে।
২০০১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর আরও বদলেছে বাঙালির জীবন। সাহিত্য ব্যাপারটাই যেন প্রান্তিক হয়ে উঠছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক লেখক স্বপন কুমারকে বোধহয় নতুন করে বোঝা দরকার। বোঝা দরকার দীপক চ্যাটার্জির গতিবিধিও। এ শহরে আর ড্রাগন এসে সূত্রহীন খুন করে না। ক্রমশ জটিল হয়ে উঠতে থাকা সময় এখন নিজেই ভিলেন। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফেলে আসা সময়ের সব স্মারককে উলটে পালটে দেখতে বসে অবহেলা করা যাবে না সেকালের এক বেস্ট সেলার লেখককে। তাঁর উদ্যম, ধারাবাহিকতা, পরিশ্রমকে কুর্নিশ করতেই হবে। বুঝে নিতে হবে কীভাবে তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দার মতোই তিনিও হয়ে উঠেছিলেন একজন হিরো। আজ যে স্ট্রাগলকে তাঁর কাহিনির মতোই একই সঙ্গে রোমহর্ষক ও অবাস্তব বলে মনে হয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.