বিশ্বদীপ দে: ‘জানলার কাচে বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে। হন্যে বাতাস পালটে দেওয়ার ইচ্ছে।’ সময় সব সময়ই বাতাস হয়ে বয়ে যাচ্ছে। আর পালটে দিচ্ছে। বা দিতে চাইছে। সেই সব পরিবর্তনের মধ্যে মাথা উঁচু করে জেগে থাকে কিছু দ্বীপ। এই ধ্রুবকগুলি জন্ম-মৃত্যু, জয়-পরাজয়ের নিক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে জানে। যেমন শচীনের ব্যাটিং বিপ্লব। অথবা ‘দূরে কোথাও দু-এক পশলা বৃষ্টি’ হওয়ার মনখারাপ করা বিকেল। সময় বদলে গেলেও বুকের পাঁজরে লেগে থাকে এই সব কীর্তি ও অনুভব। ঠিক তেমনই তিনি ও তাঁর গান। কবীর সুমন। স্পর্ধার নির্ভার উচ্চারণে যিনি বলে ওঠেন, ‘কার তাতে কী, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি?’ ভিড় বাস হোক কিংবা নির্জন পরিসর, তিনি বুকের বাঁ দিকে লেগে থাকেন স্বপ্নিল জলছাপের মসৃণ স্পর্শে।
সেই কবীর সুমন দেখতে দেখতে ৭৫! ভাবা যায়! ‘তোমাকে চাই’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯২ সালে। এদেশে তখন সবে ঢুকছে অর্থনৈতিক উদারীকরণের হাওয়া। তার পর একটু একটু করে কত কিছুই বদলাল। কিন্তু সুমনের প্রতি মুগ্ধতা? তা রয়ে গিয়েছে একই রকম। অবিকল। যাঁরা একবার ঢুকে পড়েছে সেই জগতে, তাঁদের কাছে তা চিরকালীন অনিঃশেষ এক যাত্রা।
যে সময়ে সুমন এসেছিলেন, সেই সময়টা যেন তাঁর জন্যই রেড কার্পেট বিছিয়ে রেখেছিল। সত্তরের উত্তাল দিন পেরিয়ে আটের দশক কেমন যেন ম্লান রোদে আনচান শান্ত এক সময়। তার পর নব্বই এল। আর বিশ্বের দরজাটা খুলে গেল আচমকাই। বহুজাতিক পৃথিবী পেপসি থেকে ইএসপিন, নানাবিধ পসরা সাজিয়ে হুস ঢুকে পড়ল ঘরের ভিতরে। কিন্তু বাঙালির নিজস্ব যা কিছু? সেখানে নতুনের স্পর্শ কোথায়? ওই এসে পড়লেন রাগী এক যুবক। চল্লিশ অবশ্য পেরিয়ে গিয়েছেন তিনি। যে লোকটা স্টেজে উঠে দর্শকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আচমকাই হাতের গিটারটা তুলে ধরে গান শুরু করে দিতেন। যেন কত কাছের। অথচ মননের বিচ্ছুরণে তিনি এক আশ্চর্য আলোকিত আসনে। তিনি নায়ক। তিনিই তারকা। তাঁর কথায় বিতর্ক হয়। হোক। তবু ক্যাসেটের ফিতে থেকে অন্ধকার মঞ্চ, ‘সুমনে দেখা’ করতে ভিড় জমালেন ‘সকলে’। সুমন হয়ে উঠলেন সেই সময়ের স্বর। যে স্বরে কথা বলবে বলে, গান গাইবে বলে হন্যে হয়ে ঘুরছিল বাঙালি।
বহু আগে তাঁরই এক সাক্ষাৎকারে শুনেছিলাম, তিনি বলছেন, জঙ্গলে যখন বাঘ হাজির হয় সবাই বুঝে যায়। যিনি অভিজ্ঞ শিকারী, তিনি নাকি একটা বেঁকে যাওয়া পাতা দেখেও তা বুঝতে পারেন। বলে ওঠেন, ”জঙ্গল গরম আছে।” কী আশ্চর্য! তাঁর আগমনটাও যেন তেমনই। বদলে যাওয়া সময়ের স্বর হয়ে হলদে-কালো এক স্পর্ধার উষ্ণতা যেন বুঝিয়ে দিল তিনি এসে গিয়েছেন। একথা ঠিক, পরবর্তী সময়ে ‘জীবনমুখী গান’ ট্যাগ লাগিয়ে তাঁর সঙ্গে আরও নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে কি সেটা সম্ভব? বাংলা গানে সুমন এক এমন একক দ্বীপ, যাকে ঘিরে ঘুরপাক সময়-ঘূর্ণি। যে একলা, অবিকল্প, অমোঘ।
কিন্তু সময় তো এক থাকে না। পালটায়। বিশেষ করে প্রযুক্তির দাপাদাপিতে তিন দশক আগের সময় এখন আরও প্রাচীন মনে হতে থাকে। ক্যাসেটের ফিতে থেকে সিডি-ডিভিডির বৃত্তাকার পরিসর হয়ে পেন ড্রাইভের চৌহদ্দি পেরিয়ে গান আজ মুক্ত। ডিজিটালের অসীম আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের জীবনও তাই। সবকিছুকে আজ আর ধরাছোঁয়ার উপায় নেই। আলো-ছায়ার ঘেরাটোপে এক জাদুমঞ্চের ভিতরে বেঁচে থাকা।
রাজনীতি হোক কিংবা এআইয়ের তৈরি করা ইলিউশন- সুমনের গানকে আজ বুঝি আরও বেশি করে দরকার। যে বুঝিয়ে দেবে ‘যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া।’ যতদিন সভ্যতা থাকবে, ততদিন এই লাইনটিকে পালটানোর ক্ষমতা হবে না কারও। ঠিক যেমন ‘পালটায় মন, পালটায় বিশ্বাস/ স্লোগান পালটে হয়ে যায় ফিসফাস/ ফিসফাসটাও পালটে যেতে পারে/ হঠাৎ কারও প্রচণ্ড চিৎকারে।’ উদাহরণ বাড়িয়ে যে লাভ নেই, সেকথা বলাই বাহুল্য। জীবনের প্রতিটি বাঁকে তাঁর গানের পঙক্তি যেন মাইলফলকের মতো জেগে রয়েছে। কোনটাকে নেবেন, আর কোনটাকে নেবেন না? পাড়ার ছোট্ট পার্ক, যেখানে ঘাসটুকুও নেই তাকে নিয়ে গান বাঁধতে জানেন তিনি। আবার এক মুহূর্তে কেমন করে ‘সহজ চোখে তাকিয়ে থাকা’কে আবিষ্কার করা যায়, সেই প্রগাঢ় প্রেমের উচ্চারণও কোনও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের পক্ষে উৎখাত করা সম্ভব নয়। তা সমকালীনতার ঘেরাটোপকে একলাফে ডিঙিয়ে চিরকালীনতার ফ্রেমে ঢুকে পড়েছে।
তিনি সমষ্টির, আবার ব্যক্তিরও। ‘রোগা রোগা চেহারার কন্টাডক্টর’দের ভিড়ে ‘জীবনের কথা বলা গানের মহড়া’র কথা বলেন তিনি। আবার একদম একা একা বিছানায় শুয়ে তাঁর গান ছুঁয়ে আমাদের চোখে পড়ে ‘বেডকভারের প্রান্তে রাস্তা, সবুজ নকশা জঙ্গল/ যখন তখন বেরিয়ে আসবে পাগলা হাতির দঙ্গল’… এই গান কী করে লেখা হয়েছিল ভাবতে বসলে কোনও ক্লু পাওয়া মুশকিল। কেবলই মনে হতে থাকে, এই দৃশ্য থেকেও গান হয়ে ওঠে? কিংবা ‘ঝিলের ধারে হঠাৎ বিকেল,/ শুইয়ে রাখা বাইসাইকেল’ এই দৃশ্যকল্প? এমন কত! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘রেফারেন্স’ হয়তো একটু পুরনো মনে হতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গানের হৃদয় খুঁড়লেই বেরিয়ে আসবে অপূর্ব আলোর ঝরনা। পুনর্জন্মের পর পুনর্জন্ম পেরিয়ে তা জন্মদাগের শিলালিপি হয়ে থেকে যাবে। মলিন হওয়ার প্রশ্নই নেই।
‘বনস্পতির ছায়া’ দিতে দিতে সেই মানুষটি আজ ৭৫। পবিত্র সরকার বলেছেন, সুমন আজও বাংলা ভাষার সেবা করে চলেছেন। লক্ষ রাখতে হবে এখানে কেবল গানের কথা তিনি বলেননি। সত্যিই তো, সুমনের গান কি কেবল গান? গানের কথায় লেগে থাকা ‘টেক্সট’ও আলাদা করে এক অসামান্য পাঠ অভিজ্ঞতা। শোনা যায়, সেই কোন এক বইমেলায় তাঁর গানের সংকলন প্রকাশিত হতে না হতেই ‘হট কেক’ হয়ে গিয়েছিল। আজ নেট ভুবনে সবই লভ্য। কিন্তু এই সহজতা তাঁর গানের কথাকে সুলভ করে দেয়নি। তা আজও সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সুমন-পাগলদের কাছে এক অমোঘ মন্ত্রের মতো। আগামী রবিবার, ১৭ মার্চ ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর আয়োজনে তাঁর গান শুনতে ফের অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় বাঙালি। নিজের এতদিনের সৃষ্টির সঙ্গে এখন তাঁর সাধনা বাংলা খেয়াল নিয়ে। সৃষ্টির নেশায় মত্ত সুমন রয়েছেন আমাদের সঙ্গে। আর রয়েছে তাঁর গান। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, জীবনের পর জীবন টিকে থাকার স্পর্ধা নিয়ে। সেই স্পর্ধার কাছে জীবনের মানে খোঁজা বাঙালির ফুরবে না। কক্ষনও না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.