নির্মল ধর: এক অপরাধীর সাজা হতে লেগে গিয়েছিল ১৪ বছর। তাও অপরাধ প্রমাণিত নয় সেভাবে। তা নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর। আরুষি তলোয়ারের খুনের মতো ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি আজও একটা ধাঁধা। অনেকে পক্ষে মত দেন। বিপক্ষে দাঁড়ানোর মানুষেরও অভাব নেই। কেউ কেউ মনে করেন যা সকলে দেখেছেন, তার ভিতরেও কিছু থেকে গিয়েছে। ১৩ বছর পর সে বিতর্ক ফের উসকে দিয়েছেন পরিচালক অরিন্দম শীল। সদ্য মুক্তি পেয়েছে তাঁর ধনঞ্জয় সিনেমাটি। তা সিনেমাটি কোথায় পৌঁছে দিল দর্শককে?
১৯৯০-এর মার্চে কলকাতার এক অভিজাত ফ্ল্যাটে খুন হন হেমা পারেখ (ছবিতে নাম পরিবর্তিত)। তাঁকে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগে ফ্ল্যাটের নিরাপত্তারক্ষী ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে (এখানে অবশ্য একই নাম রাখা হয়েছে) ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয় ২০০৪-এর ১৫ আগস্ট। অর্থাৎ সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করে একজন অভিযুক্তকে অপরাধী সাব্যস্ত করতে মাননীয় আদালতের সময় লেগেছিল চোদ্দটা বছর। এই ঘটনাই প্রমাণ করে দিচ্ছে আমাদের বিচারব্যবস্থা কতটা ফুলপ্রুফ, আর কতটাই বা সত্যভিত্তিক। ২০১৭-তে পরিচালক অরিন্দম শীল এবং তাঁর টিম আসলে ধনঞ্জয়ের ফাঁসির ১৩ বছর পর সেদিনের বাস্তব ঘটনার পুনর্নির্মাণেরই একটি চেষ্টা করলেন ‘ধনঞ্জয়’ ছবিতে। তাঁর এই প্রয়াসে ভিত হল চারজন তদন্তকারীর প্রায় ১০০০ পাতার একটি রিপোর্ট। সেই রিপোর্ট আকারে ইঙ্গিতে নয়, স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছিল যে, হেমা পারেখের খুনের দায় ধনঞ্জয়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোনও প্রভাবশালী মহলের চাপে। চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত এবং পরিচালক অরিন্দম শীল সেই হাজার পাতার রিপোর্টের ভিত্তিতেই তৈরি করেছেন এই ‘ধনঞ্জয়’।
ছবির দু’টি ভাগ। প্রথম অংশে দেখানো হয়েছে সাক্ষী, দু’পক্ষের উকিল এবং শেষ পর্যন্ত আদালত কীভাবে ধনঞ্জয়কে অপরাধী সাব্যস্ত করে। যেখানে সঠিক প্রমাণাদির অভাব প্রকট। তাঁর মৃত্যুদণ্ড সারকামস্টেন্সিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াই। ছবির দ্বিতীয় অংশে আমরা দেখি, সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে তরুণী উকিল কাব্য সিনহা (মিমি চক্রবর্তী) এবং তাঁর উপরওয়ালা মিঃ চৌধুরীর (কৌশিক সেন) সওয়াল জবাবে ঘটনার ভিতরের প্রকৃত ঘটনাটিকে। যেহেতু ছবিটি একটি কোর্টরুম ড্রামা, সেখানে তর্ক-প্রতিতর্ক, প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন, সাক্ষীদের বারবার কাঠগড়ায় আসা, দর্শককে মাঝেমাঝে ক্লান্তি এনে দেয়। কিন্তু আগ্রহ বজায় থাকে। বাদী ও বিবাদী পক্ষের উকিলদের চাপানউতোরে। বিশেষ করে কাব্য সিনহার চরিত্রে মিমি চক্রবর্তী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ধনঞ্জয় ও তাঁর পরিবারের আত্মিক ও সাংসারিক সংকটকে প্রকাশ করেছেন। তুলনায় প্রথম অংশে ধনঞ্জয়ের পক্ষে দাঁড়ানো উকিল মীর তেমন দাগ কাটতে পারেননি। আসলে এই ধরনের সংলাপ নির্ভর সিনেমায় জোরদার অভিনয় না হলে দর্শককে বসিয়ে রাখা মুশকিল। যেটা করতে পেরেছেন মিমি চক্রবর্তী তো বটেই, অনেকাংশে মিঃ চৌধুরির ভূমিকায় কৌশিক সেনও।
ছবির কাঠামোয় অতীত এবং বর্তমান এসেছে বারবার কাট-টু-কাট স্টাইলে। এছাড়া অবশ্য উপায়ও ছিল না। পরিচালক অরিন্দম শীল এরই মধ্যে রহস্য এবং উত্তেজনার আবহটিও তৈরি করে দেন চিত্রনাট্যের পরতে পরতে। এখানেই তাঁর সাফল্য। কিন্তু বাংলা সিনেমায় এ ধরনের কোর্টরুম ড্রামা দর্শক কীভাবে নেবেন বলা মুশকিল। তবে এই ছবিতে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে যে প্রশ্নগুলি তুলেছেন সেগুলো অবশ্যই দর্শককে ভাবাবে। ধনঞ্জয়ের যে শাস্তি হয়েছিল, তার নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল এক ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা। সেখানে না ধনঞ্জয়, না হেমা পারেখ-কারও প্রতি কোনও সমবেদনা ছিল না। ছিল পাঠককে গালগল্প শোনানোর উদ্দেশ্য। এবং সেই গালগল্প শুনেই তৎকালীন কিছু রাজনৈতিক মানুষও প্রভাবিত হয়েছিলেন। যা এক ধরনের অপরাধও বটে। অরিন্দম শীল সেই প্রশ্নটাই তুলে ছবিটিকে অন্য মাত্রা দিতে চেয়েছেন।
অভিনয়ের দিক থেকে বলতে গেলে, মুখ্য ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য তেমন সুযোগ পাননি। তবে যেটুকু পেয়েছেন প্রমাণ করে দিয়েছেন তাঁর ক্ষমতা। বলতে হবে হেমা পারেখের মায়ের ভূমিকায় সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কথা। আপাত শান্ত মেজাজের মধ্যেও যে রাগ এবং ক্ষোভ চাপা ছিল, তা অনবদ্যভাবে অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আবহে বিক্রম ঘোষ ন্যূনতম যন্ত্রাদি ব্যবহার করেও কাজের কাজটি করে দিয়েছেন।
‘ধনঞ্জয়’ ছবিটি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়া সমালোচনায় উত্তাল। কিন্তু ছবি দেখার পর হয়তো সেই উত্তেজনা প্রশমিত হবে। কারণ, ছবিটি শেষ পর্যন্ত বিচারবিভাগকে কোনওরকমভাবেই খাটো করেনি, করতে পারেও না। সুতরাং যা হল সেটা শুধু ব্যবসার জন্যই হল। কিন্তু সত্যি ব্যবসাটাও হবে কি? বা বিচারবিভাগের কোনও পরিবর্তন? তা সময়ই বলবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.