মেঘ কেটে গিয়েছে। ষষ্ঠীর রোদ ঝলমলে সকাল। মেয়েরা মেয়েদের চরম শত্রু, এই কথাটা স্রেফ ক্লিশে প্রমাণ করার বছরে এই পুজোটা আমাদের জন্য আরও বেশি রঙিন। লিখছেন প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত।
না, উওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে জটিল লেখা আপনাদের ষষ্ঠীর সকালে পড়তে বসতে বলছি না। একটু পরেই নিশ্চয়ই নতুন শাড়ি পরে, সাজগোজ করে পুজো প্যান্ডেলে বেরোবেন। এর মধ্যে বেশি সময় তাই নেব না। ছোট্ট করে শুধু মনে করিয়ে দিই- ইউ আর আ সুপারউওম্যান। দেবীপক্ষ বলে নয়। সারা বছরের জন্য। আর এখন, এই #MeToo ঢেউয়ে তো আরও বেশি করে।
কফিহাউসের কভার স্টার ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যেমন আক্ষরিক অর্থে সুপারউওম্যান। এ বছর পুজোয় তাঁর ছবি নেই তো কী, লঞ্চ করে ফেলেছেন নিজস্ব ফ্যাশন লেবেল। কিন্তু শুধু ঋতুপর্ণা বা বিখ্যাতরা নন, আমরাও নিজেদের মতো করে নারীশক্তির প্রতীক।
নরম-গরম
‘উইকার সেক্স’ কথাটা এখন একেবারে অর্থহীন। বাইরে থেকে দেখলে আমাদের নরম মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা তো মোটেই সেটা নই, তাই না? না হলে পুজোর ঢাকের আওয়াজের মধ্যে দিকে দিকে এ ভাবে প্রতিবাদের গর্জন ওঠে? কথা হচ্ছিল ইএসপিএন ক্রিকইনফো-র সিনিয়র এডিটর শারদা উগরার সঙ্গে। দীর্ঘকাল ধরে যিনি ছিলেন দেশের একমাত্র মহিলা ক্রিকেট জার্নালিস্ট। “মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে আগে মেয়েদের দাবি ছিল, তাদেরও নাইট শিফট দেওয়া হোক। বা তারাও মাঠে গিয়ে রিপোর্টিং করবে। এখন তারা নিজেদের অন্যান্য অধিকার নিয়েও অনেক বেশি সচেতন,” মন্তব্য শারদার। অন্যান্য অধিকার বলতে নিজেদের সম্মান নিয়ে সচেতনতা। কোনটা নিগ্রহ আর কোনটা নয়, সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকা। পুরুষ সহকর্মীদের কতটুকু অ্যালাউ করা যায়, তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু একসঙ্গে কাজ করা মানেই যে আপনার উপর আপনার পুরুষ কলিগের অধিকার জন্মে গেল, তা একেবারেই নয়।
[ ব্যোমকেশের ডেরায় ঘুরে এলেন ব্যোমকেশ ]
বাঁচব নিজের শর্তে
মেয়েদের মতামত অনেকে যথেষ্ট সিরিয়াসলি নেন না। সুন্দরী মেয়ে হলে তো আরওই। ভুক্তভোগী ইউটিউব তারকা এবং সংগীতশিল্পী শাওন দত্ত। বলছিলেন, “এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে মেয়েদের যেভাবে পিজনহোল করা হয়, দেখে শক্ড হয়ে গিয়েছিলাম। সে কেমন পোশাক পরছে, কী ভাবে কথা বলছে, তাকে কেমন দেখতে- শুধু এ সবের ভিত্তিতে মেয়েদের বিচার করা হত।” অতএব, কাজের ক্ষেত্র থেকে জেন্ডার সংক্রান্ত স্ট্রেস কমাতে ফ্রিলান্সিং বেছে নেন শাওন। “মেশিন কাউকে আপত্তিকর প্রস্তাব দেয় না। মেশিনকে কিছু করতে বললে সে শোনে। তাই আমি ভারচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে কাজ করে খুব, খুব খুশি। দরকার ছাড়া আমি লাইভ মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে কাজ করি না। করলেও নিজের শর্তে করি।”
প্রেগন্যান্সিতেও বিন্দাস
প্রেগন্যান্ট অবস্থাতেও এখন মেয়েরা ঘরবন্দি হচ্ছেন না, উলটে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, প্রেগন্যান্সি নিয়ে তাঁরা অনেক বেশি খোলামেলা। পাঁচ-সাত বছর আগেও ম্যাটার্নিটি ওয়ের মানে ছিল ঢোলা পোশাক। আর এখন? করিনা কাপুর থেকে নেহা ধুপিয়া, সোহা আলি খান থেকে সানিয়া মির্জা- সগর্বে মেলে ধরছেন তাঁদের বদলে যাওয়া শরীর। তাঁদের দেখাদেখি আপনাদের কেউ কেউও নিশ্চয়ই প্রেগন্যান্সিকে পুজো সাজের হার্ডল হিসেবে দেখছেন না। মোর পাওয়ার টু ইউ।
আই ডোন্ট নিড আ ম্যান
আমরা অনেকেই এখন স্বেচ্ছায় পুরুষহীন জীবন বেছে নিচ্ছি। পুরুষহীন মানে আক্ষরিক অর্থে নয় কিন্তু। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তেত্রিশ বছরের প্রিয়াঙ্কা বেশ কয়েক বছর স্টেডি রিলেশনশিপে আছেন। বিয়ে বা লিভ-ইনের ইচ্ছে নেই তাঁর। প্রেমিক সেটা জানেন। “এখনও পর্যন্ত ও যথেষ্ট সাপোর্টিভ। কিন্তু ভবিষ্যতে সেটা না-ও থাকতে পারে। এক মাস বা এক বছর পর ওর মনে হতেই পারে যে, এ ভাবে টানা যাচ্ছে না,” বলছিলেন প্রিয়াঙ্কা। তাতে কিন্তু বিশেষ চিন্তিত নন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “বিয়েটা আলটিমেটাম হয়ে দাঁড়ালে আমি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসব। তাতে সাময়িক কষ্ট নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছে উপেক্ষা করে ওর মন রাখতে পারব না।”
প্রিয়াঙ্কার মতো আরও অনেকে আছেন, বিয়ে বা সংসার করা যাঁদের জীবনের মোক্ষ বা একমাত্র লক্ষ্য নয়। পুরুষ-সঙ্গ ছাড়াও যাঁদের জীবন সম্পূর্ণ। না হলে মেয়েদের সোলো ট্রিপ এত জনপ্রিয়তা পায় না। না হলে বিবাহিত মহিলারাও দিনকয়েকের জন্য একা ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন না। এঁদের কাছে কারও মেয়ে বা কারও স্ত্রী বা কারও মা হওয়াটাই একমাত্র পরিচয় নয়। তার বাইরেও এঁদের নিজস্ব অস্তিত্ব আছে, যে অস্তিত্ব এঁরা চুটিয়ে উপভোগ করছেন।
[ লাইভ কিশোর কুমারের গান শুনতে চান? ঢুঁ মারুন বেনিয়াটোলা লেনে ]
গুলাব গ্যাং
নারীশক্তি ২০১৮-র এটাই এক্স ফ্যাক্টর। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই যে একটার পর একটা #MeToo দুঃস্বপ্ন ফাঁস হচ্ছে আর সেই মেয়েদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন চেনা-অচেনা অনেক মহিলা, একতার এমন জোয়ার ভারত কেন, যে কোনও দেশের সামাজিক ইতিহাসে বিরল। এই পাশে দাঁড়ানো শুধু ফেসবুক বা টুইটারে সীমাবদ্ধ নেই। নেমে এসেছে বাস্তবের মাটিতেও। ইন্ডিয়ান স্পোর্টস স্টাডি নিয়ে লিখতে গিয়ে শারদা উগরাকে যেমন একটা অডিট করতে হয়েছিল যে, এ দেশে কতজন মহিলা ক্রীড়া সাংবাদিক কাজ করছেন?
তার পর শারদা এবং কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের উদ্যোগে যত বেশি সম্ভব জার্নালিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, ইমেল মারফত। সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলে সেই মেলিং লিস্টে। যার মধ্যে রয়েছে যৌন নিগ্রহের ইস্যুও। “আমাদের এই গ্রুপটা একটা সাপোর্ট সিস্টেমের কাজ করে। কিছু হলে যাতে গ্রুপ মেম্বারদের এটুকু স্বস্তি থাকে যে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর লোক আছে,” বলছিলেন শারদা।
এ রকমই আর এক ‘গুলাব গ্যাং’-এর স্রষ্টা ফ্রিলান্স জার্নালিস্ট ঋতুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়। শুরু করেছিলেন #Sisterhood টুইটার থ্রেড দিয়ে। যেখানে মিডিয়ায় কাজ করতে ইচ্ছুক মেয়েদের জন্য একত্রিত করা হয় জব অফার থেকে শুরু করে মেন্টরিং টিপস, সব কিছু। আর এখন #MeToo ক্যাম্পেনকে আরও মেনস্ট্রিম করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঋতুপর্ণা। যৌন নিগ্রহের শিকার মেয়েদের নিয়ে নিরন্তর লিখে তো চলেইছেন। পাশাপাশি শুরু করেছেন আরও একটা হ্যাশট্যাগ বিপ্লব #MeTooIndia, যাতে এ ধরনের ঘটনা আরও সহজে যত সম্ভব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
আরও অনেকে আছেন। যাঁরা নিজেরা হয়তো যৌন হেনস্থার শিকার হননি। কিন্তু নিগৃহীতদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা, এগিয়ে দিচ্ছেন সহানুভূতি আর সাহায্যের হাত।
মেয়েরা মেয়েদের চরম শত্রু- এটা যে কোনওমতেই বাস্তব নয়, ইন ফ্যাক্ট এটা যে স্রেফ একটা ক্লিশে, তা প্রমাণ করাই বোধহয় নারীশক্তি ২০১৮-র সবচেয়ে বড় সাফল্য। দেবীপক্ষের শুরুটা এর চেয়ে ভাল হতে পারত কি? মনে হয় না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.