পুজোর আগে আপনার হাতে ঠিক এই ক’টাদিনই আছে। পুজো মেকওভার শুরু করে দিন। খোঁজ দিচ্ছেন প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত।
সপ্তমীতে বন্ধুদের সঙ্গে ডে-আউট। বড় প্যান্ডেলগুলোর ব্যাকড্রপে এমন কয়েকটা সেলফি, ইনস্টাগ্রামে দিলেই হিট। অষ্টমীর সকালে এতটা গ্ল্যামারাস দেখাতে হবে যাতে লালপাড়-সাদা শাড়ির ভিড়েও আলাদা করে সবার চোখ টানা যায়। নবমীর সন্ধেয় সবচেয়ে বড় টেস্ট। #ootd (আউটফিট অফ দ্য ডে) লেহেঙ্গা আর ছোট্ট চোলি। এতটুকু ফ্যাট দেখা যাওয়া চলবে না। কিন্তু প্রবলেম হল, সারা বছর জমিয়ে কেএফসি-পিৎজা হাট চলেছে। এক্সারসাইজ রুটিন পুরো সেট করা, কিন্তু ‘কাল থেকে করবই করব’-র ‘কাল’ যে আর আসে না। সারাক্ষণ মোবাইলে মুখ গুঁজে ঘাড় ব্যথা। স্ট্রেস আর আনহেলদি লাইফস্টাইলের ধাক্কায় স্কিনের সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছে। পুজোর আগে হাতে আর এক মাস। এর মধ্যে কি আদৌ সম্ভব, সারা বছরের অত্যাচারে বিধ্বস্ত ভিতর-বাহিরকে চাঙ্গা করে তোলা? উত্তরটা হল, হ্যাঁ।
ট্রেন করে ট্রিম
কথা হচ্ছিল ক্রোনোস জিমের কর্ণধার, স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং ট্রেনার চিন্ময় রায়ের সঙ্গে। “দেখুন, এক মাসে দারুণ রোগা হওয়া যায় না। বড় জোর দুই থেকে তিন কেজি কমানো সম্ভব,” প্রথমেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ তার। ভেঙে পড়বেন না। পুরোটা শুনুন। “তবে এক মাস নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে চোখে পড়ার মতো তফাত আসবেই। বডি অনেক টোন্ড দেখাবে। সেটাকে সূর্যোদয় ধরে নিয়ে এগোলে দেখবেন, মাসদুয়েকের মধ্যে অনেক ফিট হয়ে গিয়েছেন,” বক্তব্য চিন্ময়ের।
এক্সপার্ট টিপস:
১. অনেকেই ভাবেন দৌড়লে বা বেশি হাঁটাহাঁটি করলে বা বেশি করে সিঁড়ি ভাঙলে ওজন কমবে। এটা একটা মিথ।
২. ওজন কমানোর সেরা রাস্তা হল স্ট্রেংথ ট্রেনিং।
৩. ভাবছেন স্ট্রেংথ ট্রেনিং মানেই আবার জিমে ভর্তি হওয়ার হ্যাপা? তা কিন্তু নয়। যাঁদের জিমে যাওয়ার সময় নেই, বা ডাম্বেল ইত্যাদি ওয়েট ট্রেনিং সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য নেই, তাঁরা বাড়িতেই স্ট্রেংথ ট্রেনিং করতে পারেন।
৪. দু’হাতে দুটো দু’লিটারের জলের বোতল রেজিসট্যান্স ট্রেনিংয়ে দারুণ কার্যকরী।
৫. ছেলেরা ট্রাই করুন পুশ-আপ আর পুল-আপ। মেয়েরা হাঁটু ভেঙে পুশ-আপ করতে পারেন। আর পুল-আপের বদলে বেন্ট-ওভার রোয়িং।
৬. জলের বোতল হাতে স্কোয়াটস (বাংলায় যাকে বলে বৈঠক) করা যায়।
৭. এমনিতে ভাল ট্রেনারের নজরদারি ছাড়া স্ট্রেংথ ট্রেনিং করা ঠিক নয়। তবে এই এক্সারসাইজগুলো তুলনায় সহজ। টেকনিক্যালি একটু এদিক-ওদিক হলেও চোট পাওয়ার ভয় নেই।
৮. স্ট্রেংথ ট্রেনিংয়ের পর কার্ডিও খুব কাযর্করী। কার্ডিও ভজঘট কিছু নয়। কার্ডিও মানে সেই সব এক্সারসাইজ, যা আপনার হার্টবিট দ্রুত করে।
৯. বাড়িতে সহজ কার্ডিও হল স্পট রানিং, দ্রুত সিঁড়ি ওঠা-নামা, হাওয়ায় ঘুষি ছোড়া। এক্সারসাইজ হিসেবে এগুলো হাঁটা বা দৌড়নোর চেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং।
সপ্তাহে চার দিন এক্সারসাইজ করুন। অন্তত ৪৫ মিনিট করে।
ভরসা ইউটিউব
নানা রকম এক্সারসাইজের নাম দেখে ভয় পাবেন না। ইউটিউবে সব কিছুরই ভিডিও রয়েছে। যেখানে স্টেপ বাই স্টেপ দেখিয়ে দেওয়া আছে, কোন এক্সারসাইজ কী ভাবে করবেন, কতক্ষণ করবেন, কতবার করবেন। তবে ভিডিও টিউটোরিয়াল বাছার সময় দেখে নিন, সেই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বেশি কি না।
ডায়েট টিপস
ওজন কমানো আর ফিট থাকতে শুধু এক্সারসাইজ করলে চলবে না। লক্ষ্যপূরণের তিরিশ শতাংশ ওয়ার্ক-আউট হলে বাকি সত্তর শতাংশ ডায়েট। কলকাতার ডায়েট অ্যান্ড ওয়েলনেস ক্লিনিক ‘ডায়েট মন্ত্র’-র এক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, হেলদি ইটিংয়ের মূলমন্ত্র তিনটে। এক, প্রচুর পরিমাণে জলপান। দুই, বেশি করে ফল আর শাকসবজি খাওয়া। আর তিন, খাওয়ার পরিমাণ মেপে নেওয়া। আধুনিক ডায়েট-অভিধানে যাকে বলা হয় ‘পোরশন কন্ট্রোল’। “এর সঙ্গে আরও দুটো জিনিস খুব জরুরি – ভাল ঘুম আর মানসিক শান্তি। মনে একগাদা স্ট্রেস জমিয়ে রাখলে কোনও কাজেই সফল হওয়া যায় না,” বলছিলেন ডায়েট মন্ত্র প্রতিনিধি।
একই কথা ডায়েটিশিয়ান তানিশা দত্তগুপ্ত-র গলায়। কফিহাউস পাঠকদের জন্য তার ১০ টিপস:
১. দিনে দুই থেকে তিন লিটার জল খেতেই হবে৷
২. সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডিটক্স ওয়াটার খেতে পারেন। তাতে পেট পরিষ্কার হবে। নাম শুনে ঘাবড়াবেন না। ডিটক্স ওয়াটার খুব সহজে বাড়িতে বানানো যায়। আদা কুচি করে কেটে জলে ফুটিয়ে নিন। ফোটানো জল ছেঁকে তাতে সামান্য জায়ফল, দারচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ আর কাঁচা হলুদ গুঁড়ো দিন। চাইলে মধুও দিতে পারেন। ব্যস, ডিটক্স ওয়াটার রেডি।
৩. দ্রুত ওজন কমাতে লাঞ্চ বা ডিনার স্কিপ করবেন না। এতে উলটো ফল হতে পারে।
৪. কিটো ডায়েট বা জিরো-কার্ব-ডায়েট এখন খুব জনপ্রিয়। তবে টানা চোদ্দো দিনের বেশি এ ধরনের ডায়েট মেনে চলা উচিত নয়।
৫. জাঙ্ক ফুডকে না বলতে শিখুন। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চের মাঝে বা সন্ধের স্ন্যাক্সে জাঙ্ক ফুড এড়াতে হাতের কাছে রাখুন অামন্ড, পেস্তা বা ওয়ালনাট।
৬. সকালের চা-কফির বদলে ট্রাই করুন ফ্রুট স্যালাড। স্যালাডে পেঁপে, তরমুজ, আনারস, পেয়ারা ইনস্ট্যান্ট এনার্জি দেবে।
৭. মনের মধ্যে স্ট্রেস জমতে দেবেন না। মন শান্ত রাখতে ডিপ ব্রিদিং বা যোগব্যায়াম করতে পারেন।
৮. রাতে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম খুব দরকারি। তবে তার বেশি নয়। কারণ ঘুমের সময় শরীরে ‘লেপটিন’ হরমোন তৈরি হয়। যা খিদে কমিয়ে দেয়।
৯. খাবার ভাল করে চিবিয়ে খান। ভাল হজম হবে। টিভি দেখতে দেখতে বা ফোনে কথা বলতে বলতে খাবেন না। এতে কতটা খাচ্ছি বোঝা যায় না।
১০. পুজোয় রোগা হব বলে জিমে গিয়ে হেভি কার্ডিও করবেন না। বাড়িতেই সপ্তাহে চার—পাঁচ দিন ৪৫ মিনিট হালকা ফ্রি—হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন।
বাই বাই স্ট্রেস
‘স্ট্রেস কমান’ বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন। ষষ্ঠী পর্যন্ত কলেজ—অফিসের চাপ সামলে সপ্তমী থেকে হঠাৎ করে স্ট্রেস—ফ্রি হয়ে যাওয়া খুব একটা বাস্তবসম্মতও নয়। তবে এরও উপায় আছে। দিনে অন্তত দশ মিনিট জাস্ট নিজের জন্য রাখা অভ্যেস করুন। যে সময়টা আপনি কারও মেয়ে, কারও বোন, কারও স্ত্রী, কারও মা বা কারও কর্মচারী নন। ওই সময়টুকু আপনি স্রেফ নিজের। ফোনে ডাউনলোড করতে পারেন ‘কাম’ বা ওই ধরনের অ্যাপ, যা আপনার মেডিটেশনে আরও সাহায্য করবে। এতে স্ট্রেস একেবারে বিদায় হয়তো হবে না, কিন্তু মনে অনেকটা শান্তি আসবে। ওজন কমানো পুজো মেকওভারের একটা দিক হলে, অন্যটা হল নিজেকে সুন্দর করে তোলা। মানে স্কিন, হেয়ার ইত্যাদির দেখভাল। এক মাসে কী ভাবে নিজের সেরা রূপ আয়নার সামনে তুলে ধরবেন? প্রশ্ন করা হয়েছিল বিউটি অ্যান্ড হিলিং থেরাপিস্ট ঝিলাম বিশ্বাস বোসকে। যাঁর মা রুবি বিশ্বাস ‘সাজো’ বিউটি পার্লারের মালকিন। ঝিলামের দশ টিপস:
১. ডেলি মেকআপ বা স্কিনকেয়ার কিটে যে জিনিসগুলো ছ’মাসের বেশি ব্যবহার করেননি, সবার আগে সেগুলো ফেলে দিন।
২. সপ্তাহে দু’তিন বার সালফেট এবং প্যারাবেন ফ্রি শ্যাম্পু দিয়ে চুল পরিষ্কার করে ধোবেন। ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে বাইরে বেরোন।
৩. এই এক মাস শ্যাম্পু করার কুড়ি মিনিট আগে অয়েল ম্যাসাজ ইজ আ মাস্ট। নারকেল তেল বা হালকা হেয়ার অয়েল দিয়ে স্ক্যাল্প ম্যাসাজ করে নিন। রক্ত চলাচল ভাল হলে চুলের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
8. দৈনিক স্কিন কেয়ারের তিনটে ধাপ ফলো করুন- ক্লেনজিং, ময়শ্চারাইজিং/হাইড্রেটিং এবং স্কিন প্রোটেকশন।
৫. রোজ অয়েল-বেস্ড ফেসওয়াশ ব্যবহার করতে পারলে খুব ভাল। প্রাকৃতিক উপায়ে মুখ পরিষ্কার করতে চাইলে নারকেল তেল খুবই কার্যকর।
৬. রোজের ডায়েটে লোকাল ফল-শাকসবজি থাকুক। তা হলে ভিতর থেকে ফ্রেশ লাগবে। স্কিন গ্লো করবে।
৭. ডেলি অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাক করতে মোবাইলে ডাউনলোড করে নিন ফিটনেস অ্যাপ। তাতে সব কিছু সহজে নজরে রাখা যায়।
৮. পুজোর দশ দিন আগে পার্লারে গিয়ে ক্লিনআপ করান। তার পর একটা পুজোর আগে আগে করাতে যেতে হবে। এই সময় থ্রেডিং (আইব্রো, আপার লিপ) এবং একটা ভাল ফেশিয়াল অবশ্যই করিয়ে নিন। তফাৎ চোখে পড়বে।
৯. হেয়ার কালার করাতে চাইলে এখনই সঠিক সময়। রেড বা ‘হানি’ ন্যাচারাল লুক দেবে। রং না করাতে চাইলে হেয়ার ট্রিম করিয়ে নিন। পুজোর চারটে দিন হেয়ারস্টাইল চেঞ্জ করতে চাইলে ফুল ব্যবহার করতে পারেন। পোশাকে এ বছর যেমন ফ্লোরাল প্রিন্ট ইন, তেমনই চুলে একটা গোলাপ বা লিলি লুক চেঞ্জ করতে অনেকটা সাহায্য করে। শুরুটা হোক পুজো দিয়ে। দেখবেন, এক মাস নিজের খেয়াল রাখতে রাখতে ব্যাপারটা রুটিন হয়ে গিয়েছে। তখন আর দুর্গাপুজোর আগে প্যানিক বাটন প্রেস করতে হবে না!
এক্সপার্ট টিপস
চিন্ময় রায় (স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং ট্রেনার): ওজন কমানোর সেরা রাস্তা স্ট্রেংথ ট্রেনিং। জিমে যাওয়ার সময় না থাকলে বাড়িতেই জলের বোতলকে ওয়েট হিসেবে ব্যবহার করে ট্রেন করতে পারেন।
তানিশা দত্তগুপ্ত (ডায়েটিশিয়ান): লাঞ্চ বা ডিনার স্কিপ করলে উল্টো ফল হতে পারে। যে কোনও জনপ্রিয় ডায়েট চোদ্দো দিনের বেশি ফলো করবেন না।
ঝিলাম বিশ্বাস বোস (বিউটি অ্যান্ড হিলিং থেরাপিস্ট): এই এক মাস শ্যাম্পু করার কুড়ি মিনিট আগে অয়েল ম্যাসাজ ইজ আ মাস্ট। হেয়ার কালার করাতে চাইলে এখনই সঠিক সময়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.