Advertisement
Advertisement

Breaking News

সিসিডি-বারিস্তার যুগেও ইতিহাসের আভিজাত্যে গর্বিত ‘ফেভারিট কেবিন’

এই টেবিলেই নেতাজি কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা শুনতেন।

Surviving MNC onslaught Favourite Cabin still popular in Kolkata
Published by: Suparna Majumder
  • Posted:July 28, 2018 12:26 pm
  • Updated:July 28, 2018 12:26 pm  

শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে ঐতিহাসিক সব চায়ের দোকান। সিসিডি-বারিস্তার বাজারেও যা জলজ্যান্ত বেঁচে। এমনই কিছু চায়ের আড্ডার সন্ধানে সম্বিত বসু।

চায়ের দাম ৫ পয়সা বাড়ার জন্য সংবাদপত্রে কোনওকালে লেখালিখি হয়েছে? হয়েছিল! ঘটনাটা ’৭০ সালের আশপাশে। চিনির দাম অকস্মাৎ বেড়ে যাওয়ার জন্য দোকান মালিক নোটিস দিয়েছিলেন চায়ের দাম ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ পয়সা হবে। তা নাপসন্দ হওয়ায় ‘যুগান্তর’ সংবাদপত্রে কড়া রিপোর্ট লিখেছিলেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি প্রায়শই আসতেন আরও কবি বন্ধুদের জুটিয়ে।

Advertisement

৬৯ বি সূর্য সেন স্ট্রিট কেবলমাত্র ঠিকানা। কিন্তু ‘ফেভারিট কেবিন’ বললে এই ঠিকানার সঙ্গে জুড়ে যায় অবিস্মরণীয় ইতিহাসও। আজ এই ২০১৮ সালে ফেভারিট কেবিন একেবারে ১৯১৮ সালের মতোই। হঠাৎ ঢুকে পড়লে মনে হবে টাইম মেশিনের ভিতর দিয়ে এখানে চা খেতে আসা।

চট্টগ্রাম থেকে আসা দুই ভাই নূতনচন্দ্র বড়ুয়া ও গৌর বড়ুয়া শুরু করেছিলেন এই কেবিন। শ্বেতপাথরের গোল টেবিল, কাঠের পায়া। বসার জন্য কাঠের চেয়ার। কোণঘেঁষা ছোট্ট ক্যাশ কাউন্টার। খাবার বলতে কড়া ব্রেড টোস্ট, লেবু চা, দুধ চা। এবং অবশ্যই পান কেক! বড়ুয়ারা বৌদ্ধ বলেই কোনও দিন এখানে ডিম-মাংসর দেখা মেলেনি। কিন্তু এই নিরামিষ কারণে ফেভারিটের ‘ফেভারিট’ হয়ে উঠতে বাধা পড়েনি।

[নওয়াজকে ডিরেক্ট করাটা খুব চ্যালেঞ্জিং, কেন একথা তন্নিষ্ঠার মুখে?]

দেখতে কিছুই পালটায়নি, কেবল চুনকাম করানো হয়েছে বারকয়েক। সেঞ্চুরি পার করেও ঘাম জবজবে হয়ে যায়নি তার শরীর, ক্লান্তি চোখে পড়েনি, এখনও লম্বা ফুটওয়ার্কে বেহাল তবিয়তে রান করে চলেছে কলেজপাড়ার এই কেবিন। হয়তো চার-ছয় মারছে না। ক্যাফে কফি ডে কিংবা বারিস্তা হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের ক্লাসিক সেঞ্চুরি এই ফেভারিট কেবিনের। রবীন্দ্রধাঁচা থেকে বাংলা সাহিত্যকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল ‘কল্লোল যুগ’। যাদের অন্যতম হোতা ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। তিনি ‘কল্লোল যুগ’ বইতে লিখেছিলেন এই কেবিনের কথা–

‘দোকানের মালিক চাটগেঁয়ে ভদ্রলোক, নাম যত দূর মনে পড়ে, নতুনবাবু সুজন সুলভ স্নিগ্ধতায় আপ্যায়ন করতেন সবাইকে। সে সংবর্ধনা এত উদার ছিল যে চা বহুক্ষণ শেষ হয়ে গেলেও কোনো সংকেতে সে যতিচিহ্ন আঁকত না। যতক্ষণ খুশি আড্ডা চালিয়ে যাও জোর গলায়।…

বহু তর্ক ও আস্ফালন, বহু প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যচিত্রণ হয়েছে সেই ফেভারিট কেবিনে। ‘কল্লোল’ সম্পূ্র্ণ হত না যদি না সেদিন ফেভারিট কেবিন থাকত।’

স্রেফ কল্লোলরাই নয়, ফেভারিটে আসতেন শিবরাম চক্কোত্তিও। এখনকার মালিকদের একজন, চা-পায়ীদের প্রিয় কঙ্কদা জানালেন শিবরাম চক্রবর্তীর বসার দু’টি পছন্দের টেবিলও ছিল। তিনি ধীরস্থির গতিতে আসতেন। তাঁর চায়ের দু’টি টেবিল ফাঁকা না থাকলে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেখানে। টেবিলে থাকা দলটি তাঁকে চিনতে পেরে টেবিল ছেড়ে দিত অবিলম্বে। এটাই ছিল ফেভারিট কেবিনে শিবারামোচিত স্টাইল!

চার নম্বর টেবিলটির কথা না বললে ‘ঐতিহাসিক’ ক্রটি থেকে যাবে। এই টেবিলেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা শুনতেন। প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন এখানে নিয়মিত যাওয়া-আসা ছিল তরুণ সুভাষের। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও ফেভারিট কেবিন হয়ে উঠেছিল স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীদের গোপন ডেরা। রান্নাঘর সংলগ্ন চোরাগোপ্তা ছোট ঘরটিতে তৈরি হত বিপ্লবীদের আগামী ছক। আসতেন স্বয়ং সূর্য সেনও। কতবার যে পুলিশ এসেছে এবং কাউন্টারে থাকা দুই বড়ুয়া বিপ্লবীদের সতর্ক করেছেন, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। পিছনের ছোট গেট দিয়ে তখন বিপ্লবীরা পালিয়ে উঠতেন অন্য নিরাপদ রাস্তায়।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও আসতেন এই কেবিনে। বছরকয়েক আগে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিটির কিছু দৃশ্য শুট হয়েছে এখানেই। তরুণ কবি-প্রকাশকের ঠিকানা এখনও এটাই। বহু বৃদ্ধ মানুষ এখনও ধারাবাহিক ভাবে সকালের চা-টা এখানেই খেয়ে যান। আশপাশের দোকান থেকে কেউ বোতলে করে নিয়ে যায় চা। এখনও তর্ক চলে, চলে রাজনীতি। এখনও পান কেকে কামড় একবার, একবার চায়ে চুমুক।

’৯০ সালের গোড়ায় কত যে ছোট ছোট ছেলে এখানে কাজ করত। তারাই চা দিত এই দোকানে, দোকানেই থাকত। এখন শিশুশ্রমিক নিয়োগ করা যায় না বলে সেই চল নেই আর।

[বাঙালির প্রিয় রহিম সাহেব হবেন অজয় দেবগণ, প্রযোজনায় বনি কাপুর]

কেবলমাত্র এই কচি সংসদই নয়, আরও একটা কচি জিনিস অবশ্য ফেভারিটে আর পাওয়া যায় না। তা হল টিপ বিস্কুট। টিপ বিস্কুট বড় সাইজের দু’টাকার কয়েনের মতো বেকারির বিস্কুট। একসঙ্গে ছ’টা-আটটা এক প্লেটে নিয়ে চা খাওয়ার চল ছিল তখন। হিন্দু হস্টেলে এমন অনেকেই ছিল যারা ভাত খাওয়ার আগে আর এক কাপ চা খেতে আসত এই কেবিনে। পুরনো টেবিল-চেয়ার এখনও অপেক্ষারত নতুন কবিতার জন্য, নতুন বিপ্লব, সিনেমা, ছবি বা তর্কের জন্যও।

তবু, ফেভারিট কেবিন কিছুটা পালটালে ভালই হত। তা অবশ্য কেবিন না, কেবিন মালিকদের অবস্থা। কলকাতার বহু পুরনো চায়ের দোকান এই ফেভারিট কেবিন যদি সত্যি হেরিটেজের তকমা পেত! তাতে অবশ্য হাসি উড়ে যায়নি দোকান কর্মীদের। কঙ্কদা আজও তাঁর নিশ্চিন্ত হাসি হেসেই কথা বলেন খরিদ্দারদের সঙ্গে। হাসির ভিতর কোনও চিরস্থায়ী বিষণ্ণতা লুকনো আছে কি না- তা অবশ্য জানি না।

বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: শহরের বিভিন্ন ক্যাফেতে ধূমপান নিষেধ হলেও, এই ফেভারিটে চা-সহযোগে বা বিনা চায়ে সিগারেটে কোনও আপত্তি নেই।

ছবি- সুব্রত কুমার মণ্ডল

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement