সোনু দ্য সুপারম্যান। কুড়ি ঘণ্টা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরাচ্ছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর কার্টুন। সোনু সুদকে ফোনে ধরলেন শুভঙ্কর চক্রবর্তী।
কোনও এক শনিবারের কথা। পাঁচজন শ্রমিক মুম্বই সেন্ট্রালের কাছে আটকে ছিলেন। বাড়ি বিহারের দ্বারভাঙ্গায় তাঁদের। টুইটারে আকুতি “বাড়ি ফিরতে চাই”। সঙ্গে তাঁর ফোন নম্বরও পোস্ট করেন পরিযায়ী শ্রমিক বরকত আলি। ট্যাগ করেন বলিউডের নামজাদা ভিলেন সোনু সুদকে। আর ঠিক কয়েক মিনিট পরে খলনায়কের রিপ্লাই-‘পরসো মাকে গোদ মে সোয়েগা মেরে ভাই। সামান বাঁধ’।
তারপর থেকে আর থামেননি সোনু। ৩৫০ শ্রমিক। ১০টা বাস। ঘর ওয়াপসি। কখনও সেই বাস ছুটেছে মুম্বইয়ের ওয়াডালা অঞ্চল থেকে উত্তর প্রদেশ। কখনও বিহার-ঝাড়খণ্ড। বাস স্ট্যান্ডে ঠায়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন টানা ২০ ঘণ্টা! সবাই বাড়ি ঠিকঠাক ফিরতে পারছে তো! সব খেয়াল রেখেছেন ‘রখওয়ালা’।
হ্যাঁ, মঙ্গলবার দুপুরে ফোনে কথা হচ্ছিল ‘মসিহা’র সঙ্গে। সোনু বললেন, “এই এখন যে কথা হচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি স্ট্যান্ডে সামনে একের পর এক শ্রমিক বাসে উঠছে, এটা দেখেও শান্তি!”
এতগুলো মানুষের বাড়ি ফিরতে পারছেন না। তাঁদের যন্ত্রণায় যেন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন সোনুও। কথাবার্তায় তা বারবার স্পষ্ট হচ্ছে। “রাস্তাঘাটে, হাইওয়েতে যখন মানুষগুলোকে দেখি, ভীষণ কষ্ট হয়। তাঁরা রোজ হেঁটে চলেছে। পেটে খিদে তাও হেঁটে চলেছে। সেটা দেখে আর থাকতে পারিনি। বলেছি তাঁদের আমাকে দুটো দিন সময় দাও, আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি। সেই শুরু। তারপর কর্ণাটক সরকার এবং মহারাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে কথা বললাম, তারাও সাহায্য করেছে। এখন হাজারের উপর মানুষ বাড়ি ফিরেছেন। এখনও ফিরছেন।” বলেন সোনু। তবে ভারতীয়র কাছে আপনি এখন আর শুধুমাত্র সোনু নন। ‘সুপারম্যান সোনু’। কিন্তু বাড়ির লোক? তাঁদের কাছের তো আপনার এক নতুন ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে।
একটা ছোট্ট হাসি। তারপর বললেন, “আমার গোটা পরিবার এ উদ্যোগের সঙ্গী। আমার স্ত্রী সোনালী পরিাযায়ী শ্রমিকদের লিস্ট তৈরি করছে। আমার বন্ধু নীতি ভীষণভাবে সাহায্য করছে। আমার অ্যাকাউন্টেন্ট পঙ্কজ খেয়াল রাখছেন, কোথায় তাঁদের বাড়ি, কবে তাঁদের রওনা দেবেন সবকিছু। আমার টিম দিনের পর দিন বড় হচ্ছে। কত নতুন সব মানুষ এসে আমার হাত ধরছে।”
আর ইন্ডাস্ট্রির বন্ধুরা ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন? “ফারহা (খান) রোজ কল করছে। খোঁজখবর নিচ্ছে। সবাই পাশে রয়েছে। মেসেজ পাচ্ছি। অভিনন্দন জানাচ্ছে। এগুলো তো থাকবেই। কিন্তু আমার মনে হয় আমি কিছুই করছি না। ঈশ্বর কোথাও না কোথাও আছেন। তিনি আমাকে বেছে নিয়েছেন এ কাজের জন্য। আর কিচ্ছু না।”
কথায় কথায় উঠে আসছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের যন্ত্রণা। আচ্ছা, আপনি নিজে কখনও বাড়ি ফিরতে না পারার কষ্ট পেয়েছেন? “ভীষণ করেছি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়তাম। বাড়ি ফেরার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করতে হত। ভীষণ স্ট্রাগলিং লাইফ ছিল। এখন যখন পরিযায়ী শ্রমিকদের দেখি, খুব রিলেট করতে পারি।”
মায়ানগরীতে আটকে প্রচুর বাঙালি শ্রমিক। ফিরতে পারছেন না। টুইটারেও নেই হয়তো তারা। বিভিন্ন রাজ্যের শ্রমিক হয়তো সোনু সুদের উদ্যোগে নিজেদের বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু আটকে পড়া বাঙালি শ্রমিকদের কথা ভেবেছেন? “হ্যাঁ আমি জানি। আমি তাঁদের জন্য সমব্যথী। পশ্চিমবাংলার সরকারের সঙ্গেও কথাবার্তা চলছে। আশারূপ কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে তাঁরাও বাড়ি ফিরবেন। কথা দিচ্ছি,” বললেন সোনু।
বাংলায় আমফান তছনছ করেছে মানুষের শেষ সম্বলটুকুও। ছাদ নেই। খাবার নেই। এমনকী পানীয় জলটুকুও নেই কয়েক হাজার মানুষের। খবর পেয়েছেন?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সোনু বললেন, “আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। মানুষের এরকম অবস্থা দেখে ভীষণ ভেঙে পড়েছি। শুধু এটুকুই বলব, দুঃখজনক ঘটনা। শুধু মনে রাখবেন, আমাদের মনকে আরও শক্ত করতে হবে। আমাদের সব কাটিয়ে উঠতে হবে।
শুধু শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হননি সোনু। ১৫০০ পিপিই কিট দান করেছেন। পরিযায়ী শ্রমিকদের মুখে অন্ন সংস্থানের প্রচেষ্টা শুরু করেন সোনু এবং তাঁর বন্ধু নীতি। নাম দেন- ‘শক্তি আনন্দম’। রোজ প্রায় ৪৫ হাজার মানুষের মুখে তুলে দেন খাবার। এপ্রিলের শেষে সোনু সুদ নিজের জুহুর হোটেল চিকিৎসা স্বার্থে তুলে দেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সোনু সুপারম্যান কারটুন কিন্তু ভাইরাল। দেখেছেন?
“হ্যাঁ। ভাল লাগে যখন মানুষ ভালবেসে স্বীকৃতি দেন। সে রূপোলী পর্দা হোক কী বাস্তব জীবনে,” হালকা হাসিতে উত্তর সোনু সুপারম্যানের।
খাওয়া-ঘুম ছেড়ে মানুষের জন্য এত কাজ করছেন। একটু বিশ্রাম নিতে হবে তো? “ঠিক নেব। যখন শেষ পরিযায়ী শ্রমিক বাসের সিটে বসবেন। আর হাসবেন। তারপর। প্রমিস!” নির্লিপ্ত উত্তর সোনুর।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.