নিউ ইয়র্কে যে সময় আজও মুছে দিতে পারেনি বিস্ফোরণ আর রক্তের দাগ। আঠারো বছর পর গ্রাউন্ড জিরো ঘুরে এলেন রুদ্রনীল ঘোষ।
একটা বিখ্যাত ঝকঝকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে যখন চুপচাপ আকাশের দিকে তাকালাম, এক বহুতল বিল্ডিংয়ের নতুন কাচে পুরনো সূর্যের আলোটা আছাড় খেয়ে টপকাল সোজা আমার চোখে। একটু ধাঁধিয়ে গেল চোখটা। বুঝলাম বয়স হচ্ছে। আবার তাকালাম ওই বিল্ডিংয়ের মাথায়। আবার সূর্য উঁকি মারল আমার সানগ্লাস ভেদ করে। মুহূর্তেই আমার কানের কাছে ভয়ংকর দুটো বিস্ফোরণের শব্দ হল। ধুলো-ধোঁয়ায় আর অগণিত মানুষের আর্তনাদে আমার চোখ ভিজল জলে। সম্বিৎ ফিরে অক্ষত চেহারায় সানগ্লাস খুলে বুঝলাম আমার স্মৃতির বয়স আজ ১৮ হল। সে প্রাপ্তবয়স্ক!
আমার অক্ষত শরীর আর আমার স্মৃতি দু’জনে হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালাম ৯/১১ সরণিতে। নতুন পোশাক পরা টুইন টাওয়ার্সের সামনে। ৫ জুলাই, ২০১৯।
আজ আমার ঘড়িতেও প্রায় সেই সাড়ে এগারোটা। ঠিক ২০০১ সালের মতো একটা সকাল। টুইন টাওয়ার্স, একটু দূরেই ম্যানহ্যাটন। কর্মব্যস্ত দিন। দুটো প্লেন হঠাৎ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল টুইন টাওয়ার্সের আকাশছোঁয়া অহংকারকে। সন্ত্রাসবাদী হানায় মারা গেছিলেন প্রায় তিন হাজার আমেরিকাবাসী। এদেশের ঘড়িতে সেদিন সকাল ১১.৩০। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর।
সে সময় আমার টালিগঞ্জে স্ট্রাগল পিরিয়ড। দিন আনি দিন খাই হাল! রাতে খবরটা শুনে টিভি দেখব বলে এক বন্ধুর বাড়ি ঢুকেছিলাম। টিভিতে বারবার গোঁত্তা মারছে দুটো প্লেন। ধুলোর মতো গুঁড়িয়ে পড়ছে আকাশছোঁয়া দুটো বাড়ি। মানুষ প্রাণ বাঁচাবার মিথ্যে আশায় বহুতলের জানলা ভেঙে পটাপট লাফ দিচ্ছে মাটি ছোঁবে বলে। বেঁচে বাড়ি ফিরে স্ত্রী-সন্তানের বুকে মাথা গুঁজে ‘আমি বেঁচে গেছি গো’ বলে আনন্দে কেঁদে ফেলবে বলে! নাহ, কেউ বাঁচেনি তারা। কান্নার তো সীমান্ত হয় না, আতঙ্কেরও দেশ হয় না, আমার কেরিয়ারের স্ট্রাগলকে খুব ছোট লেগেছিল ওই মানুষগুলোর বাঁচার স্ট্রাগলের কাছে। গুম হয়ে গেছিলাম ক’দিন।
আঠারো বছরের স্মৃতির সিঁড়ি বেয়ে চোখ খুললাম। ২০১৯-এ। টিভিতে দেখা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া সেই টুইন টাওয়ার্স আবার বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে নতুন শরীরে সেজেছে। আমার বুকে স্টিম ইঞ্জিনের বাষ্প! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সমাধিস্থলের কাছে দাঁড়ালাম। দেখলাম আমি একা নই। সারা বিশ্বের মানুষ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। একটা শান্ত জলাধারের পার কালো গ্র্যানাইট দিয়ে বাঁধানো। সেই গ্র্যানাইটে খোদাই করা ১৮ বছর আগের ৯/১১-তে নিহত নিরীহ মানুষগুলোর নাম।
হু-হু করে উঠল বুকটা। খেয়াল করলাম আমার পায়ের পাশে পড়ে আছে একটা সাদা গোলাপ। নিচু হয়ে কুড়িয়ে সেই গোলাপ রাখলাম ওই অচেনা নামগুলোর পাশে। মনে হল হয়তো আমারই স্বজন। কী জানি কেন কান্না পেল। চোখটা সানগ্লাসে ঢেকে কেঁদেই দিলাম। কী করব, কান্নার যে পাসপোর্ট লাগে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.