শেষবার করেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। মুখ্য চরিত্রে রজতাভ দত্ত। লিখছেন সংযুক্তা বসু।
মঞ্চ জুড়ে একটি প্রাসাদ। প্রাসাদের দেওয়ালগুলো কাচের মতো স্বচ্ছ। ভেতরে যা ঘটছে তা বাইরে থেকে দেখা যায়। নিভে যাওয়া মোমবাতির ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে পড়ছে প্রাসাদের ঘরে। হঠাৎ একটা শব্দ! শব্দ শুনে প্রহরী দু’জন উঠে দাঁড়ায়। আর ঠিক সেই সময়ে ঘরে ঢোকে যারা তাদের দেখতে অনেকটা সিরিয়ালের অভিনেতা-অভিনেত্রীর মতো। তারা অপেক্ষা করতে থাকে শের আফগানের জন্য।
ঠিক এভাবেই কী হয়? কী হয়? কৌতূহল জারি রেখেই আজ প্রথম মঞ্চস্থ হল ‘শের আফগান’ নাটকটির প্রথম দৃশ্য। ‘শের আফগান’ চরিত্রে অভিনয় করে ১৯৬৬ সাল থেকে বছরের পর বছর সারা ভারত মাত করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নাট্যকার লুইজি পিরানদেল্লোর মূল নাটক ‘হেনরি ফোর’ এর আত্তীকরণ (অ্যাডাপটেশন) করেছিলেন অজিতেশ তাঁর ‘শের আফগান’—এ।শনিবার দুপুর ৩টেয় অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের মঞ্চে নতুন ‘শের আফগান’-এর ভূমিকায় দেখা গেল অভিনেতা রজতাভ দত্তকে। ‘সংস্কৃতি’ নাট্যদল প্রযোজিত এ নাটকের পরিচালক সেই দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, যিনি রজতাভকে নিয়ে এর আগেও দু’টি নাটক করে দর্শকদের মাত করেছেন। ‘উইংকল টুইংকল’ ও ‘তুঘলক’।
এখনও অনেক মানুষ বেঁচেবর্তে আছেন যাঁরা অজিতেশের অভিনয়ে বিখ্যাত ‘শের আফগান’ দেখেছেন। এবং আজ থেকে রজতাভর ‘শের আফগান’-ও দেখবেন। তুলনায় তো অজিতেশ আসবেনই। এই চ্যালেঞ্জ রজতাভর কাছে কতখানি? রজতাভ উত্তর, “প্রত্যেকটা নতুন নাটকই চ্যালেঞ্জ। তবে আগের অভিনেতা অজিতেশ থাকায় ভয় বা চ্যালেঞ্জের প্রশ্ন আসে না। সমীহ হয়।” ২০২০ সালের ভাষায় ও পারিপার্শ্বিকের মাঝখানে স্থাপন করে, সমসাময়িক জীবনের ছন্দে পরিচালনা করছেন দেবেশ নতুন রূপের ‘শের আফগান’।
নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে একটি অভিনব মহলা পদ্ধতির মাধ্যমে। কেমন সে পদ্ধতি? দেবেশ জানালেন, নাটকের স্ক্রিপ্ট বলে কিছু শিল্পীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। মাসছয়েক আগে প্রিপ্রোডাকশনের সময় থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নাটকের দৃশ্য বা সিকোয়েন্সের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক মৌখিকভাবে। এসব ঘটনায় বা সিকোয়েন্সে একজন ব্যক্তি বা অভিনেতার যা প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটাই সংলাপ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সংলাপ ও শিল্পীদের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়েছে মুখে মুখে।কেন এভাবে মহলা? পরিচালকের মতে এভাবে রিহার্সাল দেওয়া হলে প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রীর রিঅ্যাকশন, সংলাপ বলা খুব স্বতঃস্ফূর্ত, সপ্রতিভ হয়ে ওঠে। মুখস্থ করা সংলাপ বলে মনে হয় না।
এ নাটকে আসছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা। আসছে বাস্তব ও কল্পনার সহাবস্থান ও সংঘাত। যুক্তি ও যুক্তিহীনতার ধন্দ নিয়ে দেবেশ ‘শের আফগান’-কে এক স্বতন্ত্র মানুষের রাজকীয় স্বেচ্ছা নির্বাসনের কাহিনি হিসেবেই মঞ্চে আনবেন। যেহেতু মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, মিথ্যা কল্পনার ব্যাপার রয়েছে নায়কের মধ্যে, তাই মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা নিয়েছেন পরিচালক নাটকের প্রস্তুতিপর্বে।এরকম বিপর্যস্ত সময়ে এক ব্যতিক্রমী মানুষের মনের বৈকল্য বা জটিলতা নিয়ে ইনডিভিজুয়ালের জন্য নাটক করা কেন? এ নাটকের প্রাসঙ্গিকতা কী? দেবেশ বললেন, “এটি আদৌ ব্যক্তিকেন্দ্রিক নাটক নয়। কোটি-কোটি মানুষের ব্যক্তিমানসের চেতন অবচেতনের জটিলতার প্রতিফলন। অজিতেশ যখন এ নাটক করেন তখনও নানা কারণে বামপন্থী মহলে বাঁকা সমালোচনা হয়েছিল।” এহেন বিতর্কিত নাটকে অভিনয় করতে রাজি হলেন কেন রজতাভ দত্ত? বর্ষীয়ান অভিনেতার প্রতি সম্ভ্রম রেখেই তাঁর বয়ান, “দেবেশের সঙ্গে তিনটে নাটক আমাকে এক-একটা নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে। পৃথিবীর নানা বিষয়ে ওর অগাধ জ্ঞান আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।”
এ নাটকে মঞ্চ, আলো, আবহ, পোশাক, সাজসজ্জা, সব কিছুর সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে জুড়েছেন দেবেশ নিজে। মঞ্চসজ্জায় সহযোগিতা করেছেন শিল্পী ছত্রপতি দত্ত। সংগীত শ্রেয়ান চট্টোপাধ্যায়ের। পোশাক পরিকল্পনায় কেয়া চক্রবর্তী ও ময়ূরছন্দা ঘোষ।
প্রথম ‘শের আফগান’—এ যাঁরা অভিনয় করেছিলেন এবং এখনও দিব্য আছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, ডক্টর পবিত্র সরকার, রণজিৎ চক্রবর্তী প্রমুখ। নতুন নাটকে শের আফগানের কল্পিত দরবারের এক মুখ্য সভাসদ হচ্ছেন রণজিৎ।শম্ভু মিত্র অভিনীত ‘তুঘলক’ চরিত্রে ফের অভিনয় করার পর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত ‘শের আফগান’-এর মিথকে রজতাভ দত্ত কতটা ভাঙতে পারবেন, তা এখন দেখার।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.