হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে একের পর এক খুন। খুনির নাম ‘হাতোড়া ত্যাগী’। ‘অ্যামাজন প্রাইম’-এ ট্রেন্ডিং ওয়েব সিরিজ এখন ‘পাতাল লোক’। সেই ‘হাতোড়া’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সঙ্গে ফোনে কথা বললেন শুভঙ্কর চক্রবর্তী।
গত পনেরো তারিখের পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন কতটা পালটেছে?
অনেক…অনেক…অনেক। ‘পাতাল লোক’ স্ট্রিমিং শুরু হল। আর ঠিক তার পর দিন থেকে রোজ সকালে শুভেচ্ছা আসছে। ফোন, টেক্সট মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার। কোন কিছুই বাদ যাচ্ছে না। আমি তো ভাবতেই পারি না, ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন বাড়িতে বসে আমাদের শো দেখছেন। অনুরাগ কাশ্যপ,
রাজকুমার রাও, মনোজ বাজপেয়ী, অপরশক্তি খুরানা ফোন করে বলছেন “কেয়া কর দিয়া তুনে ভাই!” পরিচালক অমর কৌশিক, রাজ মেহতা ফোন করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। অনুষ্কা শর্মা সেদিন বললেন, “অব হিরো কা দোস্তওয়ালা ক্যারেক্টর করনা বন্ধ!” আমিও বলে দিয়েছি, গরীব মানুষ যা রোল পাব তা-ই করব আর কী! (হাসি)
অনুষ্কা তো রিটুইট করে লিখলেন ‘সিজন ২…ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’!
হ্যাঁ। দেখলাম। গল্প লেখা চলছে। এতটুকুই বলতে পারি।
আচ্ছা, ‘হাতোড়া ত্যাগী’র মতো কখনও রেগে গিয়েছেন?
আমি দিল্লির ছেলে। একবার এক অটোড্রাইভারের সঙ্গে খুব ঝামেলা হয়েছিল। বান্ধবীর সঙ্গে বেড়িয়েছিলাম।তো ড্রাইভার ভুলভাল কথা বলছিল। মাথা এত গরম হয়েছিল, অটোর পিছনে দৌড়ে ছিলাম তারপর অটো থামিয়ে ড্রাইভারকে বের করে ভীষণ মেরে ছিলাম। এরকম রাগ কিন্তু প্রত্যেকের মধ্যেই একটু-আধটু আছে। মাঝে মাঝে যা বেরিয়েও আসে।
হাতোড়ার সঙ্গে কোথাও কি নিজের মিল খুঁজে পেয়েছেন?
ত্যাগীর কুকুর পছন্দ। আমার কুকুর-বেড়াল দু’টোই। বাড়িতে একটা পোষা মেনি আছে। কোথাও যেন মনে হয় আমি ওদের খুব বুঝতে পারি। লকডাউনে রাস্তার কুকুরগুলোর অবস্থা ভীষণ খারাপ। খাবারদাবারও পাচ্ছে না।
তাই আমি ও টিনা (স্ত্রী) রোজ দু’বেলা অ্যাপার্টমেন্টের নিচের গেটে খাবার রেখে আসি।
‘হাতোড়া ত্যাগী’র মতো এক নৃশংস চরিত্র গড়ে তুলতে মানসিক স্ট্রাগল সামলাতে হয়েছে নিশ্চয়ই?
ভীষণ। ইন্টারনাল জার্নি ছিল। চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। চরিত্রটার নিশ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিমা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি সেটা খেয়ালে রেখেছিলাম। আবহাওয়া, পরিবেশ, অনুভূতির উপর ভিত্তি করে মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে একটা বদল আসে। বিশাল ত্যাগীর ক্ষেত্রে এই শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হয়েছিল। এবং পুরো চরিত্রটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। এবং সেটাকে ধরে রাখতে আরও। এমন এক চরিত্র যে শান্ত অথচ ভিতর ভিতর একটা উত্তেজনা আছে। সবার থেকে আলাদা থাকে, একা রয়েছে। কিন্তু কোনও সারমেয়র
সঙ্গ পেলে একেবারে পালটে যাচ্ছে বিশাল। চরিত্রের মধ্যে অনেক আস্তরণ রয়েছে।
আপনার বাবা সিকিউরিটি ফোর্সে ছিলেন। সরকারি চাকরি। বাবার কাছে কখনও শুনতে হয়েছে, “তোর তো হাইট ভাল, পুলিশে চেষ্টা কর”?
(হাসি) প্রচুরবার। বাবা তা-ই চাইত। একবার তো ধমকে বলেছিল, “তোকে পুরুলিয়া মিলিটারি স্কুলে পাঠিয়ে দেব।” ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ঠিকই করেছিলাম নয় শেফ হব নয় অভিনয় করব। যা করব
তাতে ক্রিয়েটিভিটি থাকতেই হবে।
শেফ! তার মানে রান্নার হাত তো ভাল বলতে হয়।
শুধু ভাল? একবার খেলে আঙুল চাটতে থাকবেন। ১৭ই মে টিনার (স্ত্রী) জন্মদিন ছিল। কষা মাংস বানালাম। টিনা বানাল পাস্তা। বাঙালি আর ইতালিয়ান মিক্স!
এনএসডি (ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা) কিংবা এফটিআইআই (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া) এরকম কোনও প্রতিষ্ঠানে অভিনয় শেখেননি। মনে হয় না, শিখলে বলিউড এনট্রি আরও সহজ হত?
আমি ক্লাসরুম পছন্দ করি না। ইংলিশ অনার্স নিয়ে ভরতি হই কিরোরি মাল কলেজে। বই পড়েছি জানার জন্য। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য নয়। আমার মনে হয়েছিল সাহিত্যের ব্যাখ্যা একাধিক হতে পারে। আমি যেভাবে ভাবছি তা অন্যজন নাও ভাবতে পারে। এসব ভেবেটেবে থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা দিইনি। চুটিয়ে থিয়েটার করেছি। নিজেকে এক্সপ্লোর করতে চেয়েছি। যতটুকু শিখেছি নিজে নিজেই। ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। হঠাৎ ‘স্ত্রী’ ফিল্মে বড় চরিত্র করার সুযোগ পেলাম। তারপর আরও বড় চরিত্র পেলাম ‘পাতাল লোক’-এ। আসলে অভিনয় আমার কাছে আর্টফর্ম। পেশা নয়। তাই এনএসডি অথবা এফটিআইআই-তে ঢোকার চেষ্টা করিনি। আর না চেয়েছি বলিউডে সহজ এনট্রি। আজ যা হওয়ার তা এমনিই হয়েছে।
আচ্ছা, সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ দু’টো প্ল্যাটফর্মেই অভিনয় করেছেন। কিছু পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন?
– না। অভিনয়ের প্রসেস তো এক। তবে, এটা ঠিক, ওয়েব সিরিজে ন’টা এপিসোড থাকে। একেকটা চরিত্রকে আপনি সময় নিয়ে সাজাতে পারবেন। চরিত্রকে বিল্ড আপ করার সুযোগ থাকে। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় এপিসোডে আপনি চরিত্রকে পুরোপুরি সাজিয়ে তুলতে পারবেন। সিনেমার ক্ষেত্রে তা নয়। প্রথম অথবা দ্বিতীয় সিনের মধ্যেই ঢুকে পড়তে হবে চরিত্রে। বিল্ড আপ করার সময় থাকে না বললেই চলে।
আপনি তো ছিলেন প্রথমে ছিলেন কাস্টিং ডিরেক্টর। তারপর হলেন অভিনেতা। এখন দু’টোই করছেন। ‘পাতাল লোক’-এর বিশাল ত্যাগীর চরিত্রে নিজেই নিজেকে কাস্ট করেছিলেন?
– (হাসি) না না। আমি ডিরেক্টর নই। কাস্টিং ডিরেক্টর। আল্টিমেট ডিসিশন নেন খোদ পরিচালক। ‘পাতাল লোক’-এর গোটা কাস্টিং আমি দেখেছি। কিন্তু আমাকে কাস্ট করার সিদ্ধান্ত আমার নয়। আসলে এতগুলো বছর ধরে যাদের সঙ্গে কাজ করছি, তারাই আমাকে বলে, “এই চরিত্রটা তুমি করতে পারো তো?” ব্যস করে ফেলি। ‘পাতাল লোক-এও তাই হয়েছিল।
‘পাতাল লোক’-এ ‘বং কানেকশন’ কিন্তু ভীষণ স্ট্রং!
– (হাসি) হ্যাঁ। আমি, স্বস্তিকা (মুখোপাধ্যায়), অনিন্দিতা (বসু), প্রসিত (রায়) সবাই তো বাঙালি। অনিন্দিতার সঙ্গে একটা অডিশনে আলাপ হয়। আমি ওঁকে বলেছিলাম আমরা একসঙ্গে কাজ করবই। অনিন্দিতা খুব ভাল অভিনেত্রী। আর বাংলার সবাই তো স্বস্তিকাকে চেনে, আলাদা করে ওকে নিয়ে কিছু বলার নেই। অসামান্য অভিনেত্রী। ‘ভূতের ভবিষ্যত’-এ কী অভিনয় করেছেন স্বস্তিকা। অনবদ্য!
বাংলা ছবি দেখা হয় তাহলে।
– দেখা হত। এখন কমে গেছে।
বাংলা ছবির খবর রাখেন?
– টুকটাক। কলকাতায় আসাও কমে গেছে। শুটিং করতে যা আসা হয়। ‘কালি ২’ ওয়েব সিরিজ শুটিংয়ে এসেছিলাম পনেরো দিনের জন্য। গড়িয়াহাটে খুব ঘুরলাম। ছোটবেলায় শপিং ডেস্টিনেশন ছিল গড়িয়াহাট। বাবা-মায়ের সঙ্গে আসতাম। তখন আমরা থাকতাম নাকতলায়।
বাংলা ছবিতে অভিনয় করার ইচ্ছে আছে?
– আছে তো। কথাও হয়েছিল। আবির (চট্টোপাধ্যায়), অর্পিতা (চট্টোপাধ্যায়), তনুশ্রী, একসঙ্গে একটা ছবি করার কথা চলছিল। ফিল্মের নাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’। আমার প্রথম বাংলা ছবি হত ওটা। কিন্তু এখন তো সব বন্ধ হয়ে গেল। বাংলা ছবি করার ইচ্ছে কার না থাকে বলুন তো! শুধু বাঙালি বলে একথা বলছি না, কিন্তু। একজন
অভিনেতা হিসেবে বলছি।
লকডাউনের জন্য তো আপনার অভিনীত কিছু ছবি রিলিজ পিছিয়ে গেল।
– হ্যাঁ। ‘আঁখ মিচোলি’ আর ‘হেলমেট’। দু’টো ছবি নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড।
ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এখন ছবি রিলিজ করছে। মাল্টিপ্লেক্স, সিঙ্গল স্ক্রিনের মাথায় হাত। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত। আপনি কোন দলে?
– আমার কোনও দল নেই। অভিনয় শেষ। আমার কাজ শেষ। তারপর যা কিছু প্রযোজক, পরিচালক, যাঁরা টাকা ঢেলেছেন সিনেমায় এগুলো সবটা তাঁদের ব্যাপার। তাঁরা বুঝবেন। আমি অভিনয় করেছি এবং চাইব সেটা দর্শকের কাছে পৌঁছে যাক। কোন মিডিয়ামে তা পৌঁছবে তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
মহিলা ফ্যান দিনে দিনে বাড়ছে। আপনি ফেসবুকে নেই। তাই ইনস্টাগ্রামে আপনাকে ছেঁকে ধরছে। মনে হচ্ছে না, বিয়েটা একটু তাড়াতাড়ি করে ফেললাম! সিঙ্গলহুড আরেকটু কাটাতে পারতাম?
আমি ভীষণ শান্তিতে আছি। বিয়ে না করলে ডিস্ট্র্যাক্ট হয়ে পড়তাম। আমার স্ত্রী ভীষণ সুন্দরী। আমায় খুব ভালবাসে। আমি যাকে ভালবেসেছি তাকেই বিয়ে করেছি। বিয়ে করেছিলাম বলেই অভিনয়ে পুরো ফোকাস
দিতে পেরেছি, নাহলে সেটা হত না। মন ডাইভার্ট হয়ে যেত!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.