তাঁরা আজকে নিজেরাই সেলিব্রিটি। ফেসবুকে তাঁদের ভিডিও ভাইরাল হতেও সময় লাগে না। সোমক ঘোষ আর অগ্নিজিৎ সেন। ‘রেডিও মির্চি’র অসম্ভব জনপ্রিয় দুই আরজে’র সঙ্গে আড্ডায় শুভঙ্কর চক্রবর্তী৷
আপনারা তো এখন ফেসবুক সেনসেশন। লাইক-শেয়ারে যে কোনও ইউটিউবারকে টেক্কা দিচ্ছেন।
সোমক: সোশ্যাল মিডিয়ার পপুলারিটি ইজ লাইক বিয়িং রিচ ইন আ মোনোপলি। আমার কাছে এ সব ম্যাটার করে না। আবার এই পপুলারিটিই রেডিও মির্চি ব্র্যান্ড অথবা আমাদের নিজস্ব পার্সোনালিটিকে সমৃদ্ধ করছে। আমরা শহরের নানা কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ইন্টার্যাকশান করছি। এটা আমার কাছে অন্য রকম একটা পাওয়া।
অগ্নি: আমি কোনওদিন সেনসেশন হব বলে কিছু করিনি। শুধু মাথায় ছিল, নতুন কিছু করতে হবে এবং সেটা ভাল হতে হবে। যার মধ্যে কোনও ছেঁদোপনা কিংবা অন্তঃসারশূন্যতা থাকবে না। যা আট থেকে আশি, সবাইকে আনন্দ দেবে।
আপনাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও ‘ও মা গো’ নিয়ে কথা হোক?
অগ্নি: একদম। ‘ও মা গো’ আমাদের সব থেকে কাছের। আমাদের ভালবাসা আর প্যাশন।
‘ওএমজি’ শুরু হল কীভাবে?
সোমক: ২০১৭-র পুজোর ঠিক আগে আগে একটা সার্ভে হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কলকাতার রেডিও জকিদের প্রেসেন্স সেভাবে চোখে পড়ছিল না। এক্সেপ্ট মীরদা। শো প্রোডিউসার, টিম মেম্বার্স ভাবছিল নতুন কী করা যায়। ঠিক হল এমন কিছু সোশ্যাল কনটেন্ট দরকার যা মজাদার হবে। আমি ভাবছিলাম গান নিয়ে যদি কিছু করা যায়। গানটা আমি ভালই গাই।
অগ্নি: আমি ভাবছিলাম স্পোর্টস নিয়ে।
সোমক: একদিন অফিস শেষে বাড়ি ফিরেছি। ক্লান্ত। মাকে বললাম, একটু চা করে দেবে? চা করে মা সিরিয়াল দেখতে বসেছে। হঠাৎ কী যে মনে হল, মাকে অনেকক্ষণ দেখতে থাকলাম। তারপর মনে হল, আরে আমার কনটেন্ট তো এখানেই আছে। আমার মা অজান্তেই এমন সব ঘটনা ঘটায় যা খুব মজার। স্কুলে পেরেন্ট-টিচার মিটিং কিংবা কারও বিয়েতে মা এমন কিছু করেছে বা বলেছে যা নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হয়েছে। সেগুলো জড়ো করে দেখলাম প্রায় দশটা ঘটনা। সেগুলো মাথায় নিয়ে অফিসে এলাম। অগ্নি আর অত্রিকে বললাম। বললাম ছেলের চরিত্র করবে অগ্নি। আর আমি মা সাজব। তখন কিন্তু কেউ কনভিন্সড হয়নি।
অগ্নি: আই ওয়াজ কনভিন্সড।
সোমক: চুপ কর। তারপর প্রথম এপিসোড হিট করল। পেজের লাইকস বাড়ল। তারপর চার-পাঁচটা করলাম।
অগ্নি: ছ’নম্বর এপিসোডের পর থেকে অভাবনীয় রিঅ্যাকশন আসতে শুরু করল। এখন সিজন ওয়ান শেষ করে সিজন টু-ও শুরু হয়ে গিয়েছে।
বেস্ট রিঅ্যাকশন কী ছিল?
সোমক: শুধু কলকাতা নয়। আমস্টারডাম, গ্রিনল্যান্ডের মানুষও মেল করছেন। কলকাতার অবাঙালিরা মেসেজ করে বলেন, ‘‘পুরোটা বুঝতে পারছি না, কিন্তু সরলা যে বলছে জীবনটা কয়লা হয়ে গেল, সেটা বুঝতে পারছি।’’
অগ্নি: আমি এত রকমভাবে বলি যে আমার বউ সব পারে। ইনবক্সে মেসেজ আসে, ‘‘এমন কিছু আছে যা তোমার বউ পারে না?’’ (হাসি)
‘ও মা গো’ টিমে কি শুধু আপনারা দু’জন?
অগ্নি: আমরা দু’জন স্ক্রিনে থাকি। টিমে আরও দু’জন রয়েছে। অত্রি আর গোধূলি।
সোমক: অত্রি এখানকার কপিরাইটার শুধু নয়, ফোটোগ্রাফার কাম ভিডিওগ্রাফার কাম এডিটর। ওর মোবাইলেই ‘ওএমজি’-র ভিডিও শুট করা হয়। স্ক্রিপ্টেও ওর অনেক আইডিয়া থাকে।
অগ্নি: গত এক বছরে গোধূলি ইজ দ্য বেস্ট অ্যাডিশন ইন আওয়ার টিম। লুক সেট করে। প্রোডাকশনও দেখে। দারুণ সব ইনপুট দেয়। এগুলোর পর থেকেই আমাদের ভিডিও মিলিয়ন ভিউজ ছাড়িয়ে যায়। গোধূলি পুরো ব্যাপারটা সামলে রাখে। ‘ছেলে রোজ রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরে’, ‘জানো, ও গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া করে আর আমার ওপর রাগ দেখায়?’ সোমকের ইনবক্সে মায়েদের এমন সব মেসেজ আসে?
সোমক: (হাসি) ইনবক্সে আশি শতাংশ মেসেজ মায়েদেরই থাকে। তাঁরা বলেন, ‘‘তুমি বেঁচে থাকো। যা করছ, দারুণ। মায়েদের কষ্টের কথা এভাবে কেউ বলেনি।’’ বাঙালি মায়েদের কিছু ইমোশন চিরন্তন। একটা এপিসোডে মা ইমেল আইডি খুলল, পাসওয়ার্ডে বাবার নাম রাখল। এই এপিসোড রিলিজ হওয়ার পর আমি কত যে স্ক্রিনশট মেসেজ পেয়েছি, যেখানে মায়েরা সত্যিই পাসওয়ার্ড হাজব্যান্ডের নাম রেখেছেন। গতবার মাদার্স ডে-তে এক সদ্য মা-হারা ছেলে সোমককে উইশ করেছিলেন।
সোমক: ওর সঙ্গে এখনও মেসেজে কথা হয়। গত বছর সে তার মাকে হারায়। সে সময়ে ‘ও এম জি’-র একটা এপিসোড দেখে নিজেকে মায়ের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারে। এরকম অনেকে আছেন। কিছু দিন আগেই মুম্বই থেকে একটি মেয়ে দেখা করতে এসেছিল। বলল, আমাদের ভিডিও দেখে মায়ের সঙ্গে কাটানো মূহূর্তগুলো ওর মনে পড়ে।
আপনাদের ভিডিওগুলোয় বেশিরভাগ কমেন্টে নয় মা তাঁর ছেলেমেয়েকে অথবা ছেলেমেয়েরা মাকে ট্যাগ করেছে।
অগ্নি: ওগুলো দেখে বারবার মনে হয়, আমরা এমন কিছু একটা বানাতে পেরেছি, যেখানে কেউ লজ্জা-অস্বস্তিতে না পড়ে নির্দ্বিধায় মাকে বা ছেলেমেয়েদের ট্যাগ করতে পারে। গালাগালি দিয়ে ভিডিও তৈরি করা খুব সহজ। কিন্তু মজাদার ক্লিন প্রোডাক্ট তৈরি করা ভীষণ কঠিন। শিবরাম চক্রবর্তীর ভাষায় ‘নির্মল হাস্যরস’।
অফস্ক্রিন ‘মা’ হিসেবে সোমক কেমন?
অগ্নি: (হাসি) সোমকের মধ্যে বেশ একটা লাভিং ব্যাপার আছে। আর সব মায়ের মতোই ও কিন্তু একটু বেশি খিটখিটে। তবে মা তো, তাই আমি কোনও কিছুর জন্য কখনও ওকে জাজ করি না।
আর অগ্নি ‘ছেলে’ হিসেবে?
সোমক: অগ্নি খুব এনার্জেটিক। কোনও কিছুতে ‘না’ নেই। বাড়ি-অফিস এবং বৃন্দা কাকিমাকে (অগ্নির মা) যেভাবে সামলায়, তুলনাহীন। আ পারফেক্ট সন।
‘ও এম জি’-র সবচেয়ে পপুলার ওয়ানলাইনার ‘মায়ের উপর করে নাও, বউ কিন্তু সহ্য করবে না।’ সোমকের বউ দেবস্মিতা কি সব সহ্য করেন?
সোমক: (হাসি) দেবস্মিতা আমার সবচেয়ে অনেস্ট ক্রিটিক। আমার যাবতীয় ট্যানট্রাম সহ্য করে। অনেক সময় ‘ও এম জি’-র জন্য আইডিয়া দেয়। কেমন মেক আপ করলে আরও একটু বেশি মায়ের মতো লাগবে, বলে দেয়।
অগ্নি কি বিয়ে না করে ‘এই বেশ ভাল আছি?’
অগ্নি: হান্ড্রেড পার্সেন্ট ভাল আছি। দিনের শুরুতে যেখানে টুথব্রাশ রেখে যাচ্ছি, পরের দিন সেখানেই ওটা পাচ্ছি। আর কী চাই! জীবনে চাপ খুব কম।
‘বাবু’ তো জীবনে চাপ নিতে চাইছে না।
সোমক: ওর জীবনে প্রচুর ক্রাইটেরিয়া আছে। সত্যজিৎ রায়ের ফ্যান হতে হবে। ঘুম থেকে তুলে অগ্নি জিজ্ঞেস করবে ‘নায়ক’-এর তিরিশ নম্বর সিনে উত্তমকুমার কী বলেছিলেন? ‘গুগাবাবা’ ছবির অন্তর্নিহিত সোশিও-পলিটিক্যাল অর্থ বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ-লীলা মজুমদার-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়তে হবে। এই সব কিছু একজনের মধ্যে পাওয়া দুষ্কর। তাই অগ্নি ‘সদা সিঙ্গল’।
একটা সিরিয়াস প্রশ্ন করছি। রেডিও শুধু কানের ভিতর দিয়ে মনে পৌঁছনোর প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু এখন রেডিওতে কাজের পাশাপাশি আপনারা ডিজিট্যাল প্ল্যাটফর্মেও ভিডিও আপলোড করছেন। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে শ্রোতাদের আপনারা ফলো করতে বলছেন। তাহলে কি শুধু রেডিও দিয়ে কেরিয়ার গড়া যায় না? বাকি মিডিয়ামও প্রয়োজন?
অগ্নি: আমরা শুধুমাত্র রেডিও জকি নই। আমরা কনটেন্ট ক্রিয়েটার। সেটা যে কোনও প্ল্যাটফর্মের জন্য হতে পারে। রেডিও, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা বড় পর্দার জন্যেও। রেডিও মূলত শহর এবং শহরতলির মানুষের কাছে পৌঁছায়। আমরা এই বাউন্ডারিটা ভেঙে ফেলছি। রেডিওর কনটেন্ট এখন সোশ্যাল মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ছে। কানাডার বাঙালি রেডিওতে আমাদের শুনতে না পারলেও ফেসবুকে আমাদের শো দেখতে পাচ্ছে। ইউটিউবে শুনছে ‘সানডে সাসপেন্স’র মতো জনপ্রিয় রেডিও শো। রেডিও এখন লোকাল নয়, গ্লোবাল।
সোমক: রেডিওতে যখন আমরা কথা বলি, অনেকের সঙ্গে কথা বলি না। একজনের সঙ্গে বলি। ‘আপনারা শুনছেন’ বলি না। বলি ‘তুমি শুনছ’। রেডিও জকি তাই শ্রোতাদের অনেক কাছের মানুষ। মানুষ আমাদের আরও কাছে পৌঁছাতে চায়। আমরাও চাই। তাই ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম। কোনও কথোপকথনই যেন বাদ না থেকে যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.