দিল্লির বিখ্যাত ‘মোতি মহল’ এবার পার্ক স্ট্রিটে। ঘুরে এলেন প্রীতিকা দত্ত।
দরিয়াগঞ্জ, পিতমপুরা, কনট প্লেস, সফদরজংয়ের ‘মোতি মহল ডিলাক্স’ এখন কলকাতায়। মোগলাই খানাপিনার টানে যাঁরা এতদিন দিল্লি গেলেই ‘করিম’স’ কিংবা ‘মোতি মহল’ ছুটতেন, কলকাতায় তাঁদের রসনাতৃপ্তি কীভাবে হবে, সেই চিন্তার অবসান। শতাব্দী প্রাচীন ‘বাটার চিকেন’ খাওয়ার জন্য এখন পার্ক স্ট্রিট অবধি দৌড়লেই চলবে। কারণ, মণীশ গুজরালের ‘মোতি মহল ডিলাক্স’ এখন পার্ক সেন্টারের সাততলায়।
শুধু মেনুকার্ড নয়। খাবার থেকে শুরু করে ‘মোতি মহল’-এর প্রতিটা ইটে ইতিহাস যেন থমকে রয়েছে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন, জন এফ. কেনেডি। তবলাবাদক জাকির হুসেন থেকে দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আজাদ- হেন তারকা নেই যিনি ‘মোতি মহল’-এ আসেননি। বা মণীশ গুজরালের ঠাকুরদা কুন্দনলাল গুজরালের বাটার চিকেন চেখে ফিদা হননি। একবার নাকি মৌলানা আজাদ ইরান সফরে গিয়ে সেখানকার রাজা মহম্মদ রেজা পহলভিকে বলেছিলেন, “ভারতে এলে দু’টো জায়গা আপনাকে দেখতেই হবে। এক, আগ্রার তাজমহল। দুই, দিল্লির ‘মোতি মহল’। লুটিয়েনস দিল্লিতে কান পাতলে এমনটাও শুনতে পাওয়া যায়, রাজীব এবং সঞ্জয় গান্ধীর স্কুলের টিফিনবক্সেও স্থান পেয়েছে ‘মোতি মহল’-এর বাটার চিকেন। যা নাকি প্যাক করে দিতেন স্বয়ং ইন্দিরা।
[ আরও পড়ুন: হোটেল-রেস্তরাঁয় এবার একই তেলে বারবার রান্না নিষিদ্ধ ]
একটা সময় দিল্লির সাউথ ব্লকের মানুষের কাছে ‘মোতি মহল’ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, নেহরু সরকারের যত বিদেশি অতিথি আসতেন, তাঁদের মেনুতে ওই রেস্তোরাঁর বাটার চিকেন ছিল মাস্ট। সেই চিকেন না খুব ঝাল, না বেশি মিষ্টি। মাখন, টোম্যাটো, ঘন ক্রিম আর তন্দুরি চিকেনের এই অদ্ভুত পদ দেশের মানুষজনের পাশাপাশি বিদেশিরাও ভালবেসেছেন। সম্প্রতি ব্রিটিশ মাস্টার শেফ গর্ডন রামসেও ঘুরে গিয়েছেন দিল্লির ‘মোতি মহল’ থেকে।
তবে শুধু অতীত নয়। ‘মোতি মহল’-এর বর্তমানও সমান উজ্জ্বল। সেখানকার বাটার চিকেনের কথা শুনে দিল্লির বাসিন্দা অভয় চক্রবর্তী বলছিলেন তাঁর ছেলেবেলার কথা। “ছুটির দিনে বাবা গাড়ি চালিয়ে আমাদের ‘মোতি মহল’ নিয়ে যেতেন। এখন আমার মেয়ে রাধ্যাকে নিয়ে যাওয়ার পালা। কলকাতার ‘পিটার ক্যাট’-এ যেমন চেলো কাবাব, ঠিক তেমনই ‘মোতি মহল’-এর বাটার চিকেন। এ যেন একটা পরম্পরা। যা শেষ হওয়ার নয়। বাটার চিকেন ছাড়াও সমস্ত মোগলাই রান্নায় ‘মোতি মহল’ অন্য সব আউটলেটকে দশ গোলে হারাবে।”
‘দ্য ফ্লেভার্স অফ ন্যাশনালিজম: রেসিপিজ ফর লাভ, হেট অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ’ বইয়ে নন্দিতা হাকসর সুচারুভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, খাবারের স্বাদেও কীভাবে দেশভাগের প্রভাব পড়েছে। ওই অনেকটা বাঙাল-ঘটির রান্না নিয়ে লড়াইয়ের মতো। ‘মোতি মহল’ তৈরির গল্পটাও দেশভাগকে কেন্দ্র করে। গত শতকের দুইয়ের দশকের পাকিস্তানের চকওয়াল। সেখানকারই বাসিন্দা কুন্দনলাল গুজরাল। কুন্দনলাল বাবাকে হারান বেশ ছোট বয়সেই। পরিবারের মুখ চেয়ে কাজ করতে শুরু করেন পেশোয়ারের এক হোটেলে। সেখানেই বিভিন্ন তন্দুরি পদ বানানোয় হাতেখড়ি। চলছিল সব ঠিকই। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। সে যুগে রেফ্রিজারেটার না থাকায় তন্দুরের উপর ঝুলতে থাকা চিকেন বিক্রি না হলে নষ্ট হত। হোটেলের লোকসান এড়াতে কিছু একটা করা দরকার। সেই প্রয়োজন থেকেই হোটেল মালিক কুন্দনলালকে ডেকে একদিন বললেন, “এমন কিছু করো, যাতে তন্দুরি চিকেনের টুকরোগুলো পরের দিনও বিক্রির জন্য রাখা যেতে পারে। না হলে হোটেল যে চালানো দায় হচ্ছে।”
[ আরও পড়ুন: বৈশাখী দুপুরে ইলিশ, চিংড়ি, কাঁকড়ার নতুন রেসিপিতে পাত সাজান ]
মালিকের কথামতো কুন্দনলাল মাথা খাটিয়ে বের করলেন বাটার চিকেনের রেসিপি। দ্রুত পাকিস্তান জুড়ে প্রসিদ্ধ হল বাটার চিকেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে মাউন্টব্যাটন সাহেব দেশ ছাড়তেই কুন্দনলালের জীবনে উপস্থিত আরও বড় সমস্যা। দেশ স্বাধীন। কুন্দনলালের বাড়ি সীমান্তের এপারে, ভারতে। আর হোটেল পাকিস্তানে। কী হবে! পরিবার বাঁচাতে কুন্দনলাল গুজরাল খানিকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই চলে এসেছিলেন দিল্লি। আর দরিয়াগঞ্জে খুলেছিলেন ‘মোতি মহল’-এর প্রথম আউটলেট।
বাকিটা এখন সবার জানা। সময় এগিয়েছে। জায়গা বদলেছে। কুন্দনলালের নাতি মণীশ দাদুর কাজের ভার নিয়েছেন। সারা দেশে তো বটেই। ‘মোতি মহল’ পাড়ি দিয়েছে দুবাই, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশেও। পরের বার পার্ক স্ট্রিটে খেতে গেলে তা হলে আপনার গন্তব্য হোক ২৪ পার্ক স্ট্রিটের ‘মোতি মহল’। তাদের ঐতিহাসিক বাটার চিকেন না খেলে যে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা অধরা থেকে যাবে!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.