কিংবদন্তি মান্না দের শতর্বষের জন্মদিনে তাঁকে আরও একবার ফিরে দেখলেন বর্তমানরা। জানালেন কীভাবে মান্না দে তাঁদের সম্বৃদ্ধ করেছিলেন।
নতুন প্রজন্মকে তুলে ধরার ওই উদারতা আর দেখিনি: ইন্দ্রাণী সেন
অনেক দিন আগের কথা। রেডিওতে মান্নাদা আমার গান শুনে আমাকে ওঁর বাড়িতে যেতে বলেন। আমি ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। উনি আমার গানের খুব প্রশংসা করেছিলেন। আমি তখন সবে গান গাইছি। সেই সময় মান্নাদার মতো অত বড় শিল্পীর মুখে আমার গানের প্রশংসা শুনে খুব আনন্দ হয়েছিল। এরপর আমার গানের একটা অ্যালবাম আমি মান্নাদাকে দিয়েছিলাম। সেটা শুনে উনি আমার বাড়িতে ফোন করেছিলেন। সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম না। আমার মেয়ে ফোন ধরেছিল। উনি আবার ফোন করে আমাকে জানিয়েছিলেন আমার অ্যালবাম ওঁর খুব ভাল লেগেছে। অ্যালবামের গান নিয়ে ফোনে অনেক আলোচনাও করেছিলেন। এটাই মান্নাদার সবথেকে বড় গুণ। যেটা অনেকই পারেন না। মান্নাদা পারতেন। ইয়ং জেনারেশনকে খুব উৎসাহ দিতেন। এই যে নতুন প্রজন্মকে তুলে ধরা, তাদের নাম রেকমেন্ড করা, এই গুণ, এই উদারতা সব শিল্পীর মধ্যে থাকে না। এটা সত্যিই শেখার মতো।
মান্নাদা ছিলেন অসম্ভব ডিসিপ্লিনড একজন মানুষ। শিল্পীরা সাধারণত ভোলাভালা হয়, অনেকের অনেক রকম দোষ থাকে। কিন্তু মান্নাদার ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেকটা প্রোগ্রামের আগে উনি দু’তিন ঘণ্টা রেওয়াজ করতেন। অসম্ভব ধৈর্য ছিল ওঁর। একটা গান উনি বারবার গাইতেন। কিছুতেই একবারে উনি সন্তুষ্ট হতেন না। যে গানটা রেকর্ড করবেন, সেই গানটা আট-ন’বার গাইতেন। হয়তো তার মধ্যে ফার্স্ট টেকটাই রাখা হল, কিন্তু ওঁর মনে হত ঠিক হচ্ছে না। আরও কী করে ভাল করা যায়। এই গুণ সবার মধ্যে থাকে না। একজন বড় শিল্পীর মধ্যেই থাকে। যাঁরা একবার গেয়েই মনে করে দারুণ গাইলাম, তাঁদের কাছে এটা শিক্ষণীয়।
খুব সংসারী মানুষ ছিলেন মান্নাদা। স্ত্রী আর দুই মেয়ের সঙ্গে মারাত্মক বন্ডিং ছিল। মান্নাদার গাওয়া ‘আমি নিরালায় বসে’ আমার খুব প্রিয় গান। কতবার যে গানটা শুনেছি। এবার মান্নাদার শতবর্ষ। আমার গানের তালিকায় এই গানটাও থাকবে।
উচ্চারণের রাজা: রাঘব চট্টোপাধ্যায়
এমন একজন কিংবদন্তি শিল্পী নিয়ে কিছু বলাটাই আমার কাছে সৌভাগ্যের। আমার কাছে মান্না দের গান স্বপ্নের গান। আমি যে আজ একজন সংগীত শিল্পী, এর পিছনে মান্না দের অবদান অনেক। ওঁর গান আমাকে সেই সাহস, উৎসাহ জুগিয়েছে। আমার মিউজিকাল লাইফ শুরু হয়েছিল গিটার বাজানো দিয়ে। মান্না দের গান আমাকে ক্লাসিক্যাল গানের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাসিক্যাল থেকে শুরু করে সব রকমের গান, এমনকী কমেডি গানও কী অনায়াসে গাইতেন উনি। ওখান থেকেই শিখেছিলাম, সব রকমের গান গাইতে পারার দক্ষতা অর্জন করতে হয় নিয়মিত রেওয়াজের মাধ্যমে। নিজেকে শিক্ষিত হতে হবে। ওঁর প্রত্যেকটা শব্দের উচ্চারণে যে ভাওয়েলগুলো থাকে তার প্রয়োগ এবং লোয়ার অকটেভ, মিডল অকটেভ বা হায়ার অকটেভে কোথায় কতটা জোরে বলব, কতটা হালকা বলব, এই সমস্ত ব্যাপারে উনি ছিলেন রাজা। মান্না দের গান না শুনলে হয়তো আমার গান গাওয়া হত না। আমি যন্ত্র নিয়েই থেকে যেতাম। বেশ কয়েকবার ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। ওঁর একটা কথা আমি সারা জীবন মনে রাখব। উনি বলেছিলেন, “জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রেওয়াজের মধ্যে থাকবে, তুমি গান পাও কি না পাও, অনুষ্ঠান পাও না পাও, সংগীতের প্রতি তোমার ভালবাসা যেন না কমে।”
‘তুমি পুণ্য করেছিলে তাই এত ভালবাসা পাচ্ছ’: রূপঙ্কর বাগচী
ছোটবেলা থকে আমি মান্না দের গানে পুষ্ট। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আসানসোলে একটা প্রোগ্রামে তাঁর সঙ্গে পারফর্ম করার। আগে আমার গান ছিল, তার পর ওঁর স্টেজ। আমি আলাপ করতে গেলাম। আমার কাছে ওই মুহূর্তটার যে কী তাৎপর্য তা বলে বোঝতে পারব না। ছোটবেলা থেকে যাঁর গান শুনে আমি বড় হয়েছি, তিনি আজ আমার সামনে। সেদিন অনেক কথা হয়েছিল। তার মধ্যে একটা কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। উনি বলেছিলেন, “যতক্ষণ মানুষ তোমায় ভালবাসবে, সেই ভালবাসার দাম তোমায় দিয়ে যেতেই হবে। মনে রেখো তুমি আগের জন্মে অনেক পুণ্য করেছিলে, তাই এই জীবনে এত মানুষের ভালবাসা পাচ্ছ। তাই যাঁরা তোমার গান পছন্দ করে কখনও তাঁদের অবহেলা কোরো না।” আরও অনেক কথা বলেছিলেন। আজ হঠাৎ সব কথা মনে পড়ছে। উনি বলেছিলেন, “রেওয়াজ করতে কখনও ভুলো না।”
উনি খুব পরিশ্রমী ছিলেন। বড় শিল্পী হতে গেলে পরিশ্রম করতে হবে, এটা ওঁর থেকেই শিখেছি। ওঁর গান শুনলেই বোঝা যায় উনি একজন তৈরি গায়ক। সেই কারণেই যে কোনও গানে স্বচ্ছন্দ। এটাও একটা শিক্ষা। নিজেকে তৈরি করতে পারলে সব ধরনের গান গাওয়া সম্ভব। ওঁর গানের মধ্যে একটা নাটক বা ড্রামা থাকত। গানের মাঝে যে কথাগুলো উনি বলতেন, অসাধারণ।
শুধু গায়ক নন, দক্ষ কম্পোজারও ছিলেন মান্না দে। ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’ বা ‘কী দেখলে তুমি আমাতে’ এই সব গান গাইতে হলে নিজেকে সত্যিই তৈরি করতে হবে। সব ঋতু নিয়ে একটা অ্যালবাম করেছিলেন। ওই অ্যালবামের প্রত্যেকটা গান চিরস্মরণীয়। আজও তার কোনও বিকল্প নেই। ওঁর গান যতবার শুনি নতুন করে শিখি ওঁর কথা বলা, উচ্চারণ। আর একটা ব্যাপার, গানের মাঝে মাঝে উনি এত সুন্দর কথা বলতেন, যেটা শেখার মতো। আমাদের মতো শিল্পীদের উনি একটা শিক্ষা দিয়েছেন। সব সময় নিজেকে আপডেট করতে হবে। ওঁকে কখনও কারও সমালোচনা করতে শুনিনি। বরং প্রশংসা করতে শুনেছি। এত বড় মনের শিল্পী ছিলেন। ক’জন শিল্পী আছেন যিনি খোলা মনে সবার সামনে অন্য একজন শিল্পীর প্রশংসা করতে পারেন? এটা মান্না দে-ই পারতেন। আজ মান্না দের শতবর্ষে ওঁকে নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পাওয়াটা আমার কাছে ভাগ্যের ব্যাপার। আমার মনে হয় বাংলা গান যতদিন আছে, শুধু বাংলা নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে মান্না দের সৃষ্টি, গায়কী বেঁচে থাকবে।
ক্লাসিক্যাল ও কমেডিতেও নিজস্ব স্টাইল এনেছিলেন: অভিজিৎ ভট্টাচার্য
আমরা যখনই কোনও বড় গায়কের গান শুনি, সব সময় সেই গানের মিউজিক ডিরেক্টর বা কম্পোজারের নামটাও গানের সঙ্গে চলে আসে। যখন কিশোরকুমারের গান শুনি মাথায় আর. ডি. বর্মন বা এস. ডি. বর্মনের নাম আসবেই আসবে, কারণ এটা একটা কম্বিনেশন। যখন আশাজির গান শুনি তখন মাথায় আসে আর. ডি. বর্মন বা ও. পি. নায়ারের নাম। কিন্তু যখন মান্না দের গান শুনি তখন শুধু মান্না দের কথাই মনে থাকে। আমরা ভুলে যাই কে মিউজিক ডিরেক্টর। হিন্দিতে বা বাংলায় মান্না দে যত গান গেয়েছেন, সব গান শুধু মান্নাদার গান বলেই পরিচিত। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, অভিজিৎদা মান্নাদার এই গানের সুরকার কে? আমি বলতে পারব না। কারণ আমি ওই গানটা শুধু মান্নাদার গান বলেই জানি। ‘এক চতুর নার’ গানটা যখন শুনি, আজও অবাক হয়ে যাই। এই গানে যেটুকু কমেডি মান্না দে করেছেন, টিউনের ওপরেই করেছেন। অনেকেই ক্লাসিক্যাল বেসড গান গেয়েছেন, কিন্তু মান্ন দার ক্লাসিক্যাল গান একটা আলাদা ক্যাটেগরি তৈরি করেছে। যেটা মান্না দের স্টাইল। এই স্টাইলটা ওঁর তৈরি, একেবারে আলাদা একটা স্টাইল। মান্না দে যে কমেডি গান গেয়েছেন সেখানেও একটা ক্লাসিক্যাল বেস আছে। আর এটা মান্না দে বলেই সম্ভব হয়েছে।
সারাদিন আমি যত গান শুনি তার মধ্যে মান্না দের অনেক গান থাকে। যতবারই শুনি মনে হয় নতুন কিছু শিখলাম। উনি যেভাবে গেয়েছেন চেষ্টা করি সেভাবে গাইতে। ওঁর গান শুনে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। অনুষ্ঠানে আমি মান্না দের অনেক গান গাই। ‘আমি যে জলসাঘরে’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘ছমছম বাজে রে পায়েলিয়া’, ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে’ এই সব গান আমার প্রাণের গান। যখনই সুযোগ পাই, গাই। বেশ কয়েকবার ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। একটা উপকার উনি করেছিলেন। আমি সেটা সারা জীবন মনে রাখব। উনি আমাকে একটা ব্যায়াম শিখিয়েছিলেন। বিমল রায়ের স্মৃতিতে মুম্বইয়ে একটা প্রোগ্রাম ছিল। ওখানে গ্রিনরুমে আমরা বসে আছি। আমার তখন বেশ ভুঁড়ি ছিল। অবশ্য এখনও আছে। উনি আমায় বলেছিলেন, “তুমি পেটটা ভিতর দিকে টেনে কিছুক্ষণ শ্বাস আটকে রাখবে। ভুঁড়ি কমবে আর সামনে কেউ থাকলে বুঝতে পারবে না।” আমি এই ব্যায়ামটা এখনও করি। আমার সামনে কোনও সুন্দরী মেয়ে এলে আমি শ্বাস আটকে রাখি। আমার একটা আফসোস যে, আমার দুর্গাপুজোয় মান্নাদাকে আনতে পারিনি। সব কথা ফাইনাল হয়েও উনি অসুস্থতার জন্য শেষ মুহূর্তে আসতে পারেননি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.